শীতের মৌসুমী শাকসবজি খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, বিশেষ করে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব দূর করা সম্ভব। নিয়মিত শাকসবজি গ্রহণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শাকসবজিতে থাকা আঁশ যেমন হজমে সাহায্য করে তেমনি ক্যানসারসহ অনেক রোগ প্রতিরোধ করে। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি–এর উৎকৃষ্ট উৎস এই শাকসবজি। তাই দেহের গঠন ও বৃদ্ধি, শারীরিক মানসিক সুস্থতা ও সজীবতা বজায় রাখতে দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় সবজি রাখাটা জরুরি।
চলুন পরিচিত হওয়া যাক শীতকালের কিছু সবজি ও সেগুলোর গুণাগুণের সঙ্গে।
ফুলকপি
শীতকালের সবজির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও প্রায় সবার প্রিয় ফুলকপি। সবুজ পাতার মাঝখানে ধবধবে সাদা ফুলের মতো ফুটে থাকা এই সবজির চাষ যদিও অনেক কাল আগে থেকেই আমাদের দেশে শুরু হয়েছে, তবে এ্রর আদি নিবাস ইতালি বা ভূমধ্যসাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূলবর্তী কোনো অঞ্চলে। যতদূর জানা যায়, মোগল আমলে প্রথম এই উপমহাদেশে ফুলকপির আমদানি ঘটে।
প্রোটিনের দিক থেকে সবজিটি খুব সমৃদ্ধ। এ ছাড়া ফুলকপিতে রয়েছে আয়রন, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, খনিজ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিনএ, বি ১, বি ২ ও ভিটামিন সি। এতে উচ্চমাত্রার আয়রন আছে, যা আমাদের শরীরে রক্ত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গর্ভবতী মা, বাড়ন্ত শিশু এবং যাদের কায়িক পরিশ্রম বেশি হয় তাদের জন্য ফুলকপি বেশ উপকারী সবজি। ফুলকপিতে ফ্যাট বা চর্বি একেবারে নেই। জ্বর, সর্দি-কাশিসহ শীতকালের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। ফুলকপিতে “সালফোরাফোন” আছে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই সবজি পাকস্থলির ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকরী। এ ছাড়া ফুলকপি মূত্রথলি ও প্রোস্টেট, স্তন ও ডিম্বাশয় ক্যানসার প্রতিরোধ করে। এর ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যসহ পেটের নানা সমস্যা দূর করে। ওজন নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর বিধায় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের ডায়েট চার্টে জায়গা করে নিয়েছে ফুলকপি।
বাঁধাকপি
খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ উপাদেয় সবজি বাঁধাকপি। এর পাতাগুলোই হলো সবজি। যত বেশি শীত পড়ে এর পাতার বাঁধনগুলো আরও মজবুত হয় এবং এর স্বাদও বাড়ে। বাঁধাকপির আদি নিবাস দক্ষিণ ও পশ্চিম ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দেশসমূহে। ১৪ শতকে প্রথমে ইংল্যান্ডে আবির্ভুত হয় বাঁধাকপি। ইওরোপজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সবজিটি। তারপর ১৪ থেকে ১৭ শতকের মধ্যে কোনো এক সময় পর্তুগাল থেকে থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এই সবজিটি ভারতে আসে। একজন ফরাসি অভিযাত্রী জ্যাক কার্টিয়ার ১৫৪১-১৫৪২ সালে তার তৃতীয় সমুদ্রযাত্রার সময় আমেরিকায় বাঁধাকপি নিয়ে যান। বাঁধাকপিতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকায় স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় এর ব্যবহার হতো।
বাঁধাকপি সালাদ, ভাজি, তরকারি, বড়া, রোল, স্যুপ বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ (ক্যারোটিন), ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন। এ ছাড়াও আছে প্রচুর পানি। এই সবজি হাড়কে শক্ত ও মজবুত রাখে। পাকস্থলির আলসার ও পেপটিক আলসার প্রতিরোধ করে।
গাজর
গাজরকে বলা যায় “সুপার ফুড”। অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ফাইবারসমৃদ্ধ শীতকালের সবজি। তবে গাজর এখন প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। তরকারি, সালাদ, ডেজার্ট হিসেবে গাজর খাওয়া হয়।
গাজরে আছে প্রচুর পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। অন্য উপাদানগুলোর মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, প্রোটিন, ভিটামিন এ, বি ১, বি ২ ও সি।
অন্ত্রের ক্যানসার প্রতিরোধ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। কাটা–ছেড়ার ইনফেকশন কমায়। বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে। শিশুদের রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ত্বকের শুষ্কতা রোধ, চুল পরা রোধ ও নতুন চুল গজাতে এবং ওজন কমাতে গাজর সাহায্য করে।
একজন পূর্নবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন এ–র প্রয়োজন তা প্রতিদিন দুটো গাজর খেলেই পুরণ হয়। গাজরের আদি নিবাস দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও ইওরোপ। তবে চীনেই গাজরের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমলা রং ছাড়াও হলুদ, সাদা ও লাল রঙের গাজর দেখা যায়।
মটরশুঁটি
"তুমি যদি যাও, দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে/সীম আর সীম, হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইক্ষণে/তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে/নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে/ খাব আর যত গেঁয়ো চাষিদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,/হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে"।
পল্লীকবি জসীমউদদীনের “নিমন্ত্রণ” কবিতায় মটরশুঁটির এই বর্ণনা বলে দেয় মটরশুঁটি বাঙালির কত প্রিয় সবজি। কাচা, সেদ্ধ, রান্না অথবা আগুনে পুড়িয়ে সব রকমভাবেই মটরশুঁটি খাওয়া যায়। শুকনো মটরশুঁটি ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। মটরশুঁটির শাকও খাওয়া হয়। মাছ–মাংস–সবজি, সবকিছুতেই মটরশুঁটি খাওয়া যায়।
প্রাচীন নিওলিথিক যুগে সিরিয়া, তুরস্ক ও জর্ডান এলাকায় মটরশুঁটির খোঁজ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিসরের নীল নদের বদ্বীপ এলাকাতেও সে-সময়ই মটরশুঁটির চাষ শুরু হয়। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ প্রথমে আফগানিস্তানে মটরশুঁটির চাষ শুরু হয়। এরপর পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষের হরপ্পা এলাকাতেও এর চাষ শুরু হয়। এভাবেই মটরশুঁটির আবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
মটরশুঁটির গাছ বর্ষজীবী। আমাদের দেশে শীতকালে এর চাষ হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বারি) সম্প্রতি মটরশুঁটি-১,বারি মটরশুটি-২ এবং বারি মটরশুটি-৩ নামের তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মটরশুঁটি থেকে প্রায় ১০০–১৩০ কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। এতে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ফাইবার, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি আছে। এতে ফ্যাটের পরিমাণ খুব কম। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। এ সবজি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। মটরশুঁটি উদ্ভিজ প্রোটিনের একটি ভলো উৎস।
টমেটো
শীতের সবজির মধ্যে জনপ্রিয় একটি নাম টমেটো। একে আমরা সবজি হিসেবেই জানি। তবে উদ্ভিদবিজ্ঞান টমেটোকে ফল হিসেবেই অবিহিত করে। এর আদি নিবাস মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো অঞ্চলে। আমেরিকায় স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনের পর ক্যারিবীয় অঞ্চলে স্পেনীয়রা টমেটো বিতরণ করে। তারা সবজিটি ফিলিপাইন নিয়ে যায়। সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও তারপর পুরো এশিয়া মহাদেশে টমেটো ছড়িয়ে পড়ে।
টমেটো কাচা অবস্থায় সবুজ। পাকলে লাল। দু্ই রকমভাবেই এটি খাওয়া যায়। তবে লাল টুকটুকে পাকা টমেটোর রং যেমন আকর্ষণীয় তেমনি গুণাগুণও বেশি। টমেটোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, সি, পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়াম। এ ছাড়াও টমেটোতে আছে আয়রন, ফাইবার ও পানি। টমেটোর রস রক্ত পরিষ্কার করে, চর্মরোগ সারিয়ে তোলে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও রক্তাল্পতা দূর করে। ত্বকে তারুণ্য বাড়াতে ও বয়সের ছাপ দূর করতে টমেটোর জুড়ি নেই। প্রচুর ভিটামিন সি খাতায় সর্দি, কাশি, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া দূর করে। সালাদ, সস, স্যুপ এবং তরকারি হিসেবে টমেটো খাওয়া হয়। যেকোনো মুখরোচক নাশতা, মাছ-মাংস রান্নায় টমেটোর ব্যবহার খাবারের স্বাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।টমেটো সালাদ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়।
ইতালির ভেরোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের দাবি, দিনে ৮০ গ্রাম টমেটোর সস গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যের ওপর উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবারের ক্ষতিকর প্রভাব কাটে।
শিম
শিম অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় সবজি। বর্তমানে অবশ্য শীতকাল ছাড়াও বছরের অন্য সময়ও শিম পাওয়া যায়। শিম সকলেরই প্রিয় সবজি। শীতকালে দানাদার শিমের স্বাদই আলাদা। শিম দিয়ে ভাজি, ভর্তা, তরকারি সবই রান্না করা যায়।
একটা গ্রাম্য প্রবাদ আছে “মাছের মধ্যে কই আর তরকারির মধ্যে ছই”। শিমকে অনেক এলাকায় ছই বলা হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই শিম পাওয়া যায়। শিমের অনেক জাত রয়েছে। শিম শুধু স্বাদেই নয় এর মধ্যে অনেক উপকার রয়েছে। শীতকালেই শিম সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। গবেষণায় জানা যায়, শিমের পুষ্টিগুণ শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই শুধু বাড়িয়ে দেয় না, শরীরে বাসা বাধা রোগও নিরাময় করে। শিমের দানার তরকারি যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর।
শিমের তুলনা শুধু শিমই। শিম শুধু সুস্বাদুই নয় এর মধ্যে অনেক উপকারিতাও রয়েছে। শিমের মধ্যে আছে আমিষ, প্রোটিন ও ফাইবার (আঁশ)। রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও কে। কিছুটা মিনারেলও আছে। শিমে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোফাইল রয়েছে, যা কোলন ক্যানসার প্রতিকারে সাহায্য করে। যাঁদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে, তাঁরা নিয়মিত শিম খেলে উপকার পাবেন। শিম আঁশযুক্ত হওয়ার কারণে রক্তে ধীরে ধীরে সুগার প্রবেশ করে। এতে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে সুগার জমার কোনো লক্ষণ থাকে না। রক্তে শর্করার পরিমাণও নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরে কোলেস্টেরল কমাতে পারে শিম।
পালংশাক
পালংশাক শীতকালের আরেকটি জনপ্রিয় সবজি। পালংশাক দিয়ে শিং মাছ জমে ভালো। ওজন কমাতে দারুণ কার্যকর এই শাক। ওজন কমানোর জন্য দরকারি হলো কম ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ। আর পালংশাকে ক্যালোরির পরিমাণ খুবই কম থাকে। পালংশাক বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ। উপস্থিত এই দুই পুষ্টি উপাদান ক্যানসারপ্রবণ কারসিনোজেনিক কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। চোখ ভালো রাখতে পালংশাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পালংশাকে রয়েছে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি। এই দুইয়ের উপস্থিতি বিভিন্ন প্রকার চোখের অসুখ, বিশেষত ম্যাকুলার ক্ষয়ের ঝুঁকি হ্রাস করে। হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতেও পালংশাক উপকারী। হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা কমাতে পারে পালংশাক।