আমলাদের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে সরকারি দলের, বরিশালে উত্তেজনা অব্যাহত

বৃহস্পতিবার দূপুরে নগরীর কালীবাড়ি রোডে সিটি মেয়রের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ। বরিশাল, বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২০।

ইউএনওর বাসায় হামলার ঘটনাকে ঘিরে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে এক নম্বর আসামি করে মামলা ও প্রশাসন ক্যাডারের বিবৃতিকে ঘিরে বরিশালে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুরো ঘটনাকে ঘিরে প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে সরকারি দলের। পুলিশ এ পর্যন্ত আটক করেছে ১৮ জনকে। রাস্তাঘাটে টহল দিচ্ছে র‍্যাব ও পুলিশ। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের সামনে সমাবেশ করে মেয়রের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে তাঁর সমর্থকরা। কিন্তু প্রশাসন তাদের কঠোর অবস্থান থেকে সরেনি। তবে মেয়রকে গ্রেফতারের দাবিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কঠোর ভাষায় দেওয়া বিবৃতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সরকারের ভিতরে বাইরে।

অতীতে ভুল বোঝাবুঝিতে প্রশাসন ক্যাডারের সংগঠনটি এই ভাষায় বিবৃতি দেয়নি। তবে ফরিদপুরের এমপি নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের সময় প্রথম নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছিল প্রশাসন সার্ভিস। এবার বরিশালের ঘটনা সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বরিশালের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসনিক এলাকায় রাতের বেলায় ব্যানার ফেস্টুন উচ্ছেদের মতো ঘটনাকে ঘিরেই বরিশাল সদর উপজেলার ইউএনওর বাসায় হামলার ঘটনা ঘটে। জাতীয় শোক দিবসের ব্যানার ফেস্টুন খুলতে যায় সিটি কর্পোরেশন ও সরকারী দলের কর্মীরা। ইউএনও রাতে খুলতে বারণ করেন। এই নিয়ে উভয় পক্ষের তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে আনসার সদস্যদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়। হামলা করা হয় ইউএনওর বাসভবনে। এরপরই পুলিশ ও আনসারের পিটুনিতে হামলাকারীদের ৫০ জন আহত ও ৬০ জন গুলিবিদ্ধ হন। ইউএনও ও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে দুটি। পুলিশ মেয়রের বাসভবন ঘিরে রাখে। মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ বেরিয়ে এসে তাকে আটক করা হবে কি না জানতে চাইলে পুলিশ চলে যায়। তবে শহরে এখনো র‍্যাব, পুলিশের টহল চলছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীদের আটকের চেষ্টা চলছে।

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সাদিক আবদুল্লাহকে আটক ও তাদের ভাষায় “রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত”দের আটকের দাবিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে। যা এখন সর্বস্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মেয়র আজ রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, রাজনৈতিক দলের ব্যানার খোলা ও লাগানোর কাজ দলীয় কর্মীদের। এইখানে ইউএনও বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কোন বিষয় নেই।

প্রশাসনের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল বোঝাবুঝি এই প্রথম তেমন নয়। ২০১৯ সালের শুরু থেকে প্রশাসন ও পুলিশ সার্ভিসের সঙ্গে সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি, মেয়রসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের প্রকাশ্য বিরোধের খবর সামনে আসতে থাকে। সরকারি দল সংসদে অভিযোগ করেছে, প্রশাসন ভোটের পর থেকে তাদের গুরুত্ব দেন না। অনেক জেলায় উভয় পক্ষের বিভিন্ন কার্যক্রম, দূরত্ব সৃষ্টির মতো কিছু কিছু ঘটনা দুই পক্ষের মাছে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করছে।

রাজনীতিবিদরা মনে করেন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ট্রেড ইউনিয়ন স্টাইলের হুমকি দিতে পারেন না। সরকারের সাবেক মুখ্য সচিব এম এ করিম বলেন, ভুল বোঝাবুঝির পরিমাণ বাড়ছে সাম্প্রতিক সময়ে। কাউকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র চালানো সম্ভব নয়। সমঝোতার মনোভাব সবার মাঝেই থাকতে হবে। বর্তমান ঘটনাগুলো অপ্রত্যাশিত। সংযত আচরণ সব পক্ষকে করতে হবে। প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরের কেউ নন। সবাই এই দেশের বাসিন্দা। সবাইকে কাজ করতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখে। কারও চেয়ে কেউ অগুরুত্বপূর্ণ নন। সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন চলার জন্য এমন ঘটনার অবসান হওয়া দরকার। সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য খুবই প্রয়োজন সহনশীলতা, স্বাভাবিক পরিবেশ।

সার্বিক পরিস্থিতিকে দুঃখজনক বলে মনে করেন সাবেক সচিব ইব্রাহিম হোসেন খান। তিনি বিএসএস কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠান অফিসার্স ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, বিসিএস প্রশাসন সার্ভিসের একটা ভাষা আছে। আর কেউ আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটালে বা সার্ভিসের কোনো সদস্যের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এ নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন থেকে কঠোর হুমকি দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। এতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় সরকার ও প্রশাসনের মাঝে। তাছাড়া প্রশাসন থেকে এভাবে হুমকি দেওয়ার ঘটনা অতীতে ঘটেনি। সাবেক এই সচিব বলেন, সরকারি দলের যারা অন্যায় করছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে, সরকারি দল তাদের কোনোভাবে আশ্রয় ও ছাড় দিচ্ছে না। বরং কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। তারপরও এমন বিবৃতি প্রদান পরিস্থিতিকে ঘোলাটে ও সাংঘর্ষিক করবে। যা কোনোভাবে কাম্য নয়। তিনি বলেন, সবাইকে কাজ করতে হবে সমন্বয়ের ভিত্তিতে। এখানে ভুল বোঝাবুঝি ধরে রাখলে পরিণতি কারও জন্য মঙ্গলময় হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসন ক্যাডারের আরেকজন সাবেক কর্মকর্তা যিনি এখন সরকারের সঙ্গে রয়েছেন, তিনি বলেন প্রশাসন সার্ভিসের বক্তব্য-বিবৃতি কোনোভাবেই ট্রেড ইউনিয়নের মতো হতে পারে না। আবার রাজনীতিবিদরা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবেন না, যা সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি করবে রাষ্ট্রযন্ত্রে।