অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

 
পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় ইকবাল ৭ দিনের রিমান্ডে, পীরগঞ্জে 'উস্কানিদাতা' আটক

পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় ইকবাল ৭ দিনের রিমান্ডে, পীরগঞ্জে 'উস্কানিদাতা' আটক


কুমিল্লা: ইকবাল হোসেনকে শনিবার দুপুরে আদালতে নেয়া হয়
কুমিল্লা: ইকবাল হোসেনকে শনিবার দুপুরে আদালতে নেয়া হয়

কুমিল্লা নগরীর নানুয়া দীঘির পাড় এলাকার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ইকবাল হোসেনকে সাতদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তার সঙ্গে আরও তিন আসামির সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে কুমিল্লার আদালত।

বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার থেকে ইকবালকে আটক করার পর তাকে কুমিল্লায়এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার বিষয়টি ইকবাল হোসেন স্বীকার করেছেন বলে পুলিশের তরফে বলা হয়েছে। তিনি কেন সেখানে কোরআন রাখতে গেলেন, এই ঘটনায় তাকে কেউ প্ররোচিত করেছে কিনা তার বিস্তারিত জানতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শনিবার দুপুরে মাথায় হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় আসামিদের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। রিমান্ডে নেয়া অন্য তিন আসামি হলেন, পুলিশকে ৯৯৯’এ ফোন করা ইকরাম,দারোগা বাড়ি মাজার মসজিদের সহকারী খাদেম ফয়সাল ও হুমায়ুন। ঘটনার পর পুলিশ যে সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করেছে এতে ইকবালের সঙ্গে ওই দুই খাদেমেরও উপস্থিতি দেখা গেছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে।

শনিবার আদালত প্রাঙ্গণে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক টিম ও গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল হোসেন মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ রাখা এবং হনুমানেরগদাটি পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ঘটনার বিষয়ে
পুলিশকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন ইকবাল। এসব তথ্য যাচাইবাছাই করতেই তাকে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে।

ঘটনার দিন কোতোয়ালি মডেল থানার এস.আই হারুন অর রশীদ বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ও অবমাননার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরআসামি করে যে মামলাটি দায়ের করেন ইকবালকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়াও পুলিশকে ৯৯৯’এ ফোন করা ইকরাম, মাজার মসজিদের সহকারী খাদেম ফয়সাল ও হুমায়ুনকেও একই মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

গত ১৩ই অক্টোবর নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার জেরে হামলা সংর্ষের ঘটনায় কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচটি, সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ২টি এবং দাউদকান্দি ও দেবিদ্বার থানায় একটি করে মোট ৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শনিবার পর্যন্ত ৫২ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।

ওদিকে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু জেলেপল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সৈকত মণ্ডল ও রবিউল ইসলাম নামের দুইজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে র‍্যাব। সৈকতের ফেইসবুক পাতায় ধর্মীয় অবমাননার পোস্ট দেখে রংপুরের পীরগঞ্জে মানুষ জড়ো হয়ে মাঝিপাড়ায় হিন্দুদের উপর হামলা করেছিল বলে র‍্যাব দাবি করেছে। ফেইসবুকে অনুসারীর সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে ওই ব্যক্তি এমন পোস্ট দিয়েছিলেন বলে র‍্যাবের এক ব্রিফিংএ জানানো হয়। এই দুইজনকে শুক্রবার গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তারের পরদিন শনিবার সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়,সৈকতের নির্দেশে রবিউল পাশের মসজিদের মাইক থেকে লোকজনকে জড়ো হওয়ার জন্য প্রচার চালিয়েছিলেন। র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সৈকত তার ‘ফলোয়ার’ বাড়াতে উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে লোকজন জড়ো করেন।

গত ১৭ই অক্টোবর রাতে সৈকত ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন-‘এ মুহূর্তে গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে’। র‍্যাব কর্মকর্তা জানান, সৈকত পোস্ট দেওয়ার পর লোকজন জড়ো হলে একটি উঁচু ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। পরে সংঘবদ্ধ লোকজন জেলে পল্লীতে হামলা করে অন্তত ২৩টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আটক সৈকত স্থানীয় একটি কলেজের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী, রবিউল স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন।

এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছিল, হিন্দু এক তরুণের ফেইসবুকে ইসলাম‘অবমাননাকর’ মন্তব্য দেখে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। হিন্দু ওই তরুণকে ইতোমধ্যে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে থাকা স্থানীয় এক মুসলমান তরুণকেও আটক করা হয়েছে।

কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনার বিচারদাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে গণঅবস্থান, গণঅনশন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সংগঠন।শনিবার সকাল ৬টা থেকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বানে এই কর্মসূচি শুরু হয়। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান অনশন করার পর আট দফা দাবি পেশ করে সমাবেশের মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ হয়। একইরকম কর্মসূচি পালিত হয়েছে কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।

শাহবাগের কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তরফে ৮ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। ঘোষিত আট দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে ‘চল চল ঢাকায় চল’ শ্লোগানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানানো হয়। আট দফা দাবির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির, বাড়িঘর পুনঃনির্মাণ, গৃহহীনদের পুণর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি রয়েছে। এছাড়া হামলাকারী ও তাদের পেছনে থাকা চক্রান্তকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি করা হয়েছে পূজা উদযাপন পরিষদের তরফে। হামলা ঠেকাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতি চিহ্নিত করে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার দাবি করা হয়েছে পরিষদের পক্ষ থেকে।

ওদিকে কুমিল্লায় সংঘটিত ঘটনার পর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরআরো সতর্ক, সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।তারা বলছেন, ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, যার দায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা, প্রতিবাদ ও বিচার দাবি জানিয়েএক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিসহদেশের ৪৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাদের মধ্যে এমিরেটস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাশেদা কে চৌধুরী, আনু মোহাম্মদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক বিচারপতি আব্দুল মতিন, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, আলী ইমাম মজুমদার, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও গীতি আরা নাসরিন প্রমুখ রয়েছেন।বিবৃতিদাতারা মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে গত কয়েক দিনে যে সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এইসব অপরাধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, তাদেরকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

XS
SM
MD
LG