অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

কোন প্রতিকূলতার মাঝে থমকে থাকেনা বাংলাদেশের মেয়েরা: বাসিমা ইসলাম


বাসিমা ইসলাম
বাসিমা ইসলাম

বাংলাদেশের তরুণ প্রকৌশলী বাসিমা ইসলাম ফোর্বস ম্যাগাজিনের থার্টি আন্ডার থার্টির বিজ্ঞান ক্যাটেগরিতে স্থান করে নিয়েছেন।

বর্তমানে বাসিমা ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় আরবানা শ্যাম্পেইনের ভিজিটিং পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ এসোসিয়েট।আগামী বছর তিনি ওর্স্টার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজে যোগ দেবেন। বাসিমা ইসলাম ২০১৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ডিভাইস নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি এই স্বীকৃতি পান।

বাসিমা ইসলাম তার যে গবেষণার জন্য ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকায় স্থান পেয়েছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলি।

ভিওএঃ আপনি যে ডিভাইস নিয়ে গবেষণা করেছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। এটি কিভাবে মানুষকে উপকৃত করবে?

বাসিমা ইসলামঃ আমাদের ধারণা এবং সাইন্সের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে যে ২০৩৫ সালের মধ্যে আমাদের আশেপাশে প্রায় এক ট্রিলিয়ন যন্ত্র থাকবে যেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে থাকবে। এই যন্ত্রগুলো হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহৃত জিনিস।এটি আমাদের একটি কলম হতে পারে হাতের ঘড়ি হতে পারে কিংবা এটা আমার বাসার দরজাও হতে পারে।দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা ব্যবহার করি সেগুলোর মধ্যে আমরা কম্পিউটিংকে যুক্ত করতে চাই। জীবনের যাত্রাকে আরও গতিশীল মসৃণ আরও ভালো করার জন্য আমরা এটি যুক্ত করতে চাই। আমাদের এটি আরও সাহায্য করতে পারবে।

একটি উদাহরণ দিতে পারি, যেমন ধরুন আমার একটি কলম রয়েছে যেটি দিয়ে আমি শুধু লিখতে পারবো তা নয় কলমটি এটি নির্ণয় করতে পারবে যে মানুষটি কলমটি ব্যবহার করছে তা আমি না অন্য কেউ আমার হয়ে সই করে দিচ্ছে। তবে এটিও চাই যে কলমটি যেন কলমের মতোই দেখতে হয়, এর আসল বৈশিষ্ট্য যেন বোঝা না যায়।

আমরা এ ধরণের যন্ত্রকে বলি ইন্টারনেট অফ থিংস বা আইওটি।বেশীরভাগ যন্ত্রগুলো ব্যাটারি-চালিত।এক ট্রিলিয়ন যন্ত্র যেগুলো ব্যাটারি চালিত এই ব্যাটারিগুলোকে যদি আমাদের মেইনটেইন করতে হয় যেমন চার্জ করা লাগবে বা পরিবর্তন করা লাগবে তাহ’লে আমরা হিসাব করে দেখেছি পুরো বিশ্বে প্রতিদিন ২৭৩ মিলিয়ন ব্যাটারি পরিবর্তন করতে হবে। এটি একটি ঝামেলা। এবং ব্যবহারের পর আমরা এই ব্যাটারি কোথায় ফেলে দিচ্ছি? আমাদের পরিবেশের জন্য এটি খারাপ। রিসাইক্লিং করাও সম্ভব না যেহেতু এটি ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ব্যাটারি রিসাইক্লিং থেকে প্রচুর আগুন ধরে যায়। সেজন্য চিন্তা করলাম ব্যাটারি থেকে কিভাবে এবং কতটা দূরে সরে আসা সম্ভব।

ভিওএঃ আপনি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে চাইছেন যেটি ব্যাটারিকে প্রতিস্থাপন করবে?

বাসিমা ইসলামঃ আমরা বিশেষ করে এমন কিছু চাইছি যাতে করে সৌর শক্তি বা ওয়াইফাই থেকে অথবা আমরা যে হাঁটাচলা করি সে সময় আমরা যে শক্তি তৈরি করে থাকি এইগুলোকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করতে পারি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যন্ত্রগুলোকে চার্জ করার জন্য। শুধু তাই নয় আমরা চাইছি এই যন্ত্রের মাধ্যমে সুরক্ষিতভাবে তথ্য আদান-প্রদান হবে।এই তথ্যগুলো যেন মানুষের কাজে আসে এমন যেন না হয় যে মনে করল্ম এটি একটি নতুন যন্ত্র ব্যবহার করলাম কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন কাজে লাগেনা।

ভিওএঃ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য অন্য মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে, এমনটি ধারণা করছেন, তা কিভাবে রোধ করা সম্ভব?

বাসিমা ইসলামঃ আমরা যখন বলছি যে আমরা সব যন্ত্রকে কম্পিউটিং এর সঙ্গে যুক্ত করবো তখন একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে সবাই যদি আমার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাহলে সেই তথ্য কোথায় যাচ্ছে। একটি মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কি খাওয়া-দাওয়া করছে, কার সঙ্গে কি কথা বলছে সব তথ্যই বের করে দিতে পারে। আমরা এক্ষেত্রে যেটি বলছি যে আমরা এই তথ্যের যেখানে উৎস, সেখানেই তা থাকবে।এই তথ্য কোথাও পাঠানো হবে না। যে ডিভাইসটি থাকবে তার ভেতরেই যাবতীয় কম্পিউটিং হবে যতটুকু নোটিফিকেশন হিসেবে পাঠানো দরকার বা সেটি যদি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে তাহলে চিকিৎসকের কাছে যতটুকু তথ্য পাঠানো দরকার শুধু তততুকুই পাঠানো হবে। বাকি তথ্য প্রসেস হবে কিন্তু সংরক্ষিত হবে না।আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য যাতে সুরক্ষিত থাকে তার দিকে আমাদের লক্ষ্য থাকবে এবং এটি আমার গবেষণার আরও একটি বিষয়।

ভিওএঃ আপনি বলেছেন আপনার এই যন্ত্রটি সৌর শক্তি বা রেডিও তরঙ্গ থেকে শক্তি নিয়ে চলবে। তাহলে রাতের বেলা কোথা থেকে এই শক্তি পাবে যন্ত্রটি। দিনের বেলায় সূর্য থেকে যে শক্তি পাবে তা কি সংরক্ষণ করার মতো ব্যবস্থা রয়েছে যন্ত্রটিতে?

বাসিমা ইসলামঃ আমরা ব্যাটারির পরিবর্তে যেটি ব্যবহার করি তা একেবারেই নতুন একটি প্রযুক্তি যাকে আমরা বলি সুপার ক্যাপাসিটর।ব্যাটারি আর সুপার ক্যাপাসিটরের পার্থক্য দুটি। একটি হচ্ছে ব্যাটারি একটি কেমিক্যাল রি-অ্যাকশনের মাধ্যমে হয়। আমরা রসায়নের মাধ্যমে এটিকে সংরক্ষণ করি।কিন্তু ক্যাপাসিটরে হয় ফিজিক্যাল রি-অ্যাকশনের মাধ্যমে।এর ফলে যেটা হয়, ব্যাটারির একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। যখন একটি স্মার্টফোন কেনেন তখন ফোনের চার্জ অনেকক্ষণ থাকে। কিন্তু ফোনটি যত পুরনো হয় চার্জ রাখার ক্ষমতা কমে যায়।এটাকেই বলে ব্যাটারি লাইফটাইম। সুপার ক্যাপাসিটর ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে এটি কখনোই ক্ষয় হয় না এর কারণ এটিতে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়না। সে কারণেই আমরা সুপার ক্যাপাসিটর ব্যবহার করতে পারি কেননা এটির এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অনন্তকাল চলতে পারে। আমাদের যেহেতু উৎসগুলো এ ধরণের অর্থাৎ রেডিও তরঙ্গ বা সৌর শক্তি এগুলো সবসময় থাকে, কোন খরচ ছাড়া অনেক সময় ধরে আমরা এই যন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারবো।

ভিওএঃ পথে চলার সময় মানুষ আপনার যন্ত্রের মাধ্যমে কিভাবে উপকৃত হতে পারে?

বাসিমা ইসলামঃ এই বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করেছি এবং আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যে মানুষ হেডফোন পরে বা ফোনের দিকে মগ্ন হয়ে রাস্তায় চলাচল করে, চারপাশে কি হচ্ছে সেদিকে মনযোগ দেয় না, তখন আমাদের এই যন্ত্রটি একটি সংকেত দেবে যেমন বলবে, আপনার ডান দিক থেক একটি গাড়ি আসছে, তখন সেই মানুষটি সেদিকে তাকিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবে। আমরা যে কাজটি করেছি তা হলো একটি হেডফোনের সঙ্গে কিছু বাড়তি মাইক্রোফোন যুক্ত করেছি। সেখান থেকে আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করি এবং সেই তথ্য একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় যা ঐ যন্ত্রের ভেতরেই হচ্ছে। যদি কারো হাতে স্মার্টফোন থাকে তাহলে ঐ স্মার্টফোনে নোটিফিকেশন আসবে যে তিনি বিপদজনক দূরত্বে রয়েছেন তাকে সরে যেতে বলবে। তবে আমরা এটিও চাইনা মানুষ স্মার্টফোনের দিকে লক্ষ্য রাখুক ঐ নোটিফিকেশনের জন্য। তার জন্য আমরা আরও যা করেছি তা হল কেউ যদি জ্ঞান শুনতে থাকেন তাহলে তার গানের ভলিউম কমে যাবে এবং সতর্ক সংকেত দেবে। ভবিষ্যৎ এ আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে এমন একটি যন্ত্র হেডফোনের সঙ্গে যুক্ত করা যেটির পেছনে কোন খরচ হবে না। মানুষের আশেপাশে থেকেই যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করবে। আমরা বলছিনা মানুষ কম্পিউটিং এর উপর নির্ভর করুক কিন্তু আমরা এই জন্তের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করতে চাইছি।

ভিওএঃ যখন প্রথম শুনলেন আপনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকায় স্থান পেয়েছেন, কেমন অনুভূতি ছিল?

বাসিমা ইসলামঃ খুবই ভালো লেগেছে। আসলে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা ঠিক কেমন লেগেছে। আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করেছি। সত্যি কথা বলতে গেলে কাজ করতে ভালো লাগে তাই কাজ করে গেছি। মানুহস্র জন্য আরও অনেক কিছু কাজ করার ক্ষমতা আছে বলে আমি মনে করি। আমি তখনি খুশি হব যখন দেখবো আমার গবেষণা মানুষের কাজে লাগছে। এবং এই স্বীকৃতিটা আমাকে আরও কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগাবে।

ভিওএঃ বাংলাদেশে নারী বিজ্ঞানীরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন, আপনার এই সাফল্যের পর সেইসব নারী বিজ্ঞানীদের কিভাবে সাহায্য করতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?

বাসিমা ইসলামঃ অনেক সময় শুনেছি মানুষকে বলতে, “মেয়ে বলে হয়তো পারবেনা বা মেয়ে বলেই বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে এবং করছে।” এর কোনটি আসলে সত্য নয়। আমি অনেক ভাগ্যবতী, আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে সব ধরণের সাহায্য পেয়েছি। আমাকে সবসময় বলে হয়েছে আমি পারবো, এবং সে কারণেই আমি এগিয়ে যেতে পারি, এগিয়ে যাই। নিজের ওপর ভরসা রাখাটা জরুরী। যে যাই বলুক না কেন নিজেকে বলতে হবে, “আমি পারবো”। আমার পক্ষ থেকে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব আমি করবো। বাংলাদেশের মেয়েরা প্রচুর কাজ করে। তারা কোন প্রতিকূলতার মাঝে থমকে থাকেনা এবং এটিই আমাদের সবচাইতে বড় শক্তি।

XS
SM
MD
LG