আশির দশকের শেষ সময় থেকে নব্বই দশকের শেষ সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ শকুন বিলুপ্ত হয়েছে। ওই সময় মাত্র ১০ থেকে ১৫ বছরের ব্যবধানে হুট করেই দেশের আকাশ থেকে হারিয়ে যায় শকুন। এমন দাবি করছেন পাখি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এস এম ইকবাল। শকুন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশ নানা ভাবে বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। ফলে পরিবেশবিদদের মধ্যে দিন দিন উৎকন্ঠা বাড়ছে। International Union for Conservation of Nature (আইইউসিএন) এর মতে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেন জাতীয় ওষুধ শকুন ধ্বংসের মূল কারণ। এ জাতীয় ওষুধ প্রয়োগকৃত পশু মারা গেলে তার মাংস খেলে সাথে সাথেই শকুন মারা যায়। বাংলাদেশ সরকার শকুন রক্ষার তাগিদে ইতোমধ্যেই ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেন জাতীয় ওষুধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
বিপর্যয়ে পড়া এই শকুন সংরক্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির তাগিদ থেকে গোটা বিশ্বে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। আজ শনিবার সেই দিন। বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন দিনটি পালন করছে।
শকুন পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ: দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রাণী বলা হয় শকুনকে। বলা হয় প্রকৃতির ঝাড়ুদারও। এক সময় শকুনকে মানুষ অশুভ মনে করেছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে শকুন পরিবেশের জন্য আর্শিবাদ স্বরুপ। ‘প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোটে’র দাবী, শকুন প্রায় ৪০ প্রকার জীবাণু ধ্বংস করতে পারে। শকুনের পাকস্থলী এসব জীবাণু সহজেই ধ্বংস করতে সক্ষম, যা অন্যকোন প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়। শকুন শিকারী পাখিও নয়। এরা জীবত প্রাণী খায় না। পশু মরে পড়ে থাকলে তখন এরা পুরো গোত্রসহ মাটিতে নেমে খায়। ফলে পরিবেশ নির্মল এবং দুর্গন্ধমুক্ত হয়ে ওঠে। এক সময় গবাদী পশুর শরীরে এনথ্রাক্স রোগ দেখা যেতো। এই রোগে আক্রান্ত গবাদীপশুর বেশির ভাগ মারা যেতো। কিন্তু মৃত গবাদী পশুর শরীর থেকে ওই জীবাণু ধ্বংস হতো না। ফলে এপাড়া থেকে ওপাড়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তো এই জীবাণু। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে শকুন এই মারাত্মক এনথ্রাক্স জীবাণু ধ্বংস করতে পারে। ফলে শকুনকে বোদ্ধাজনরা পরিবেশের জন্য আর্শীবাদ স্বরূপ হিসেবে দেখেন।
পরিবেশের জন্য উপকারী এই শকুন কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে: আইইউসিএন অর্থাৎ International Union for Conservation of Nature এর মতে আমাদের এই উপমহাদেশে এক সময় ৪০ লাখ শকুন ছিলো। সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ হাজারে। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা এখন ২৬০টি। ২০১৪ সালের জরিপ থেকে এই তথ্য জানা যায়। বাংলাদেশের সিলেট এবং সুন্দরবন অঞ্চলে এই ২৬০ টি শকুন টিকে আছে। আমাদের দেশে এক সময় ৭ প্রজাতির শকুন দেখা যেতো। এর মধ্যে রাজ শকুন বাংলাদেশ থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলা শকুন বেশি টিকে আছে। সেই সাথে আরেকটি প্রজাতির শকুন হচ্ছে সরুঠোটি শকুন। এই প্রজাতির শকুন সর্বসাকুল্যে মাত্র ৮/১০টি রয়েছে বাংলাদেশে। এছাড়াও দেশে মাঝে মাঝে আরো তিন প্রজাতির পরিযায়ী শকুন দেখা যায়। তার মধ্যে ‘হিমালয়ান গৃধিনী’ (Himalayan Griffon Vulture) অন্যতম। হিমালয়ে অস্বাভাবিক ঠান্ডা পড়লে এরা বাংলাদেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়, নীলফামরী, দিনাজপুর এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। এরা মূলত নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে আসে এবং মার্চের দিকে আবার ফিরে যায়। পরিযায়ী শকুন প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসে এরা খাবারের সংকটে পড়ে যায়। সংগত কারণেই শীতের ওই সময়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় এদের অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতিবছর ‘হিমালয়ান গৃধিনী’ জাতের শতাধিক শকুন এ দেশে আসে। যার মধ্যে চল্লিশ শতাংশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ধরণের শকুন উদ্ধারের জন্য ২০১৪ সালে আইইউসিএন একটি প্রকল্প নেয় দিনাজপুরের সিংড়ায়। গড়ে তোলে "শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র"। গত ছয় বছরে এখানে ৯৯টি শকুন উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়েছে।
শকুন বিলুপ্তির কারণ: International Union for Conservation of Nature (আইইউসিএন) এর সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার ও বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মসূচির মুখ্য গবেষক সীমান্ত দিপু ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহু ব্যবহারের ফলে প্রাণীর মৃতদেহ খাওয়ার পর শকুনেরা দ্রুত মারা যায় এবং অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। আমরা এই ক্ষতিকর ওষুধের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেছি এবং সরকার ইতোমধ্যেই এ জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোণষা করেছে। তিনি আরো বলেন, আমরা শকুন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছি। ইতোমধ্যেই ভালো কিছু ফলাফলও আমরা পেয়েছি। বন অধিদপ্তর এবং আইইউসিএন এর যৌথ উদ্যোগে শকুন সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ করছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শকুনদের নিরাপদ খাবার দেয়া হচ্ছে। জরিপ কাজ করা হচ্ছে একং উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র গড়েতোলা হয়েছে।
পশু পাখি নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক ড. এস এম ইকবাল। তিনি শকুন বিলুপ্তির কারণেগুলো সম্পর্কে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, শকুন বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান করতে আন্তর্জাতিক ভাবে গবেষণা হয়েছে। সেই গবেষণায় বলা হয়েছে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহু ব্যবহার শকুন বিলুপ্তির কারণ। তিনি এই গবেষণার সাথে এক মত পোষণ করে আরো কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেন। সেই কারণগুলোর মধ্যে হচ্ছে শকুনের খাদ্য সংকট, বাসস্থান সংকট। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে এক সময় গরুর ভুড়ি কেউ খেতো না। পাথারে, খোলা জায়গায় এসব ফেলে দিতো মানুষ। শকুন এসব খেয়ে জীবন ধারণ করতো। যখন মানুষ গরুর ভুড়ি খাওয়া শুরু করলো তখন থেকেই বাংলাদেশের শকুন খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। এছাড়াও মানুষ পরিবেশ দুষণ থেকে বাঁচার জন্য এখন অনেক সচেতন। ফলে মৃত যেকোন প্রাণীকে মাটির নিচে পুতে রাখা হচ্ছে। এতে শকুনরা খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। আস্তে আস্তে এই সংকট প্রকট আকাড় ধারণ করলে শকুন মরে যায় আবার কিছু শকুন অন্যত্র চলে যায়। অপর দিকে বাংলাদেশে উচু বৃক্ষ নিধন করার ফলে শকুনরা আবস্থল হারায়। এটিও শকুন বিলুপ্তির একটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।
পরিবেশবাদী সংগঠন Teem for Energy and Environmental Research (TEER) এর বগুড়ার সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান এবং আরাফাত রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, পৃথিবীতে শকুনের ১৮টি প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে ৭টি প্রজাতির শকুনের অস্তিত্ব ছিল। এরমধ্যে বাংলা শকুন (White-rumped Vulture) , হিমালয়ী শকুন (Himalayan Griffon) , সরু-ঠুঁটি শকুন (Slender-billed Vulture) ও রাজ শকুন (Red-headed Vulture) ছিল এদেশের আবাসিক পাখি। যারমধ্যে দেশে একমাত্র বাংলা শকুনটিই বৈজ্ঞানিক নাম Gyps bengalensis টিকে আছে, অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খাদ্য সংকট, বনাঞ্চল উজাড়, শতবর্ষী বড় গাছপালা কমে যাওয়ার ফলে নিরাপদ আবাসস্থল ও প্রজনন ব্যাঘাত ঘটার ফলে শকুন কমে গেছে। উপমহাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ শকুন ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘তীর’ গত তিন বছরে উত্তরাঞ্চলে মোট ১৮ টি শকুন উদ্ধার করে রেসকিস সেন্টারেও নিজেরা অবমুক্ত করেছে।