ফেসবুকে আলাপ হওয়া বন্ধুকে একজন মানুষ কী ৮৮০ কিলোমিটার দৌড়তে অনুপ্রাণিত
করতে পারে? এর উত্তর জানতে ভিওএর সংবাদদাতা ম্যাক্সিম মোসকলকভ এই দু'জনের
সাথে দেখা করেন। তার এই প্রতিবেদন থেকে জয়তী দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন যে, ২০১৫ সাল থেকে ওয়াশিংটন ডিসির একজন সফল দাঁতের চিকিত্সক তারা জিয়ার, তার শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, হাঁটতে অসুবিধে এবং এক দু:সহ যন্ত্রণাদায়ক পিঠে ব্যথা, এই সব উপসর্গগুলির কারণ আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর খুব অল্প সময় পরেই তার শরীরে এই লক্ষণগুলি দেখা দেয়।
স্টিফ পার্সন সিন্ড্রোম গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তারা জিয়ার বলেন, "আমার জীবনে সেই মুহুর্তে ওই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর থেকে আমি খুব মানসিক চাপ অনুভব করছিলাম এবং আমি আমার বাচ্চাদের সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম, তারাও তাদের বাবাকে হারিয়ে খুবই দুঃখ করছিল,আমরা সবাই খুবই শোকাহত ছিলাম।" এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট, রিউমাটোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট এবং অন্যান্য অনেক ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করার পরেও তিনি জানতেন না কী হচ্ছে, এবং দিনে দিনে তার শরীরে এই লক্ষণগুলি আরও খারাপ হতে থাকে। তিনি বলেন, "আমি খুব কষ্টকরে খাট থেকে নামতে পারতাম, আমি আমার বাচ্চাদের কোন যত্ন নিতে পারতাম না, আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ী-মা আমার সাথে থাকতে চলে এসেছিলেন,আমাকে দেখাশোনা করার জন্য এবং আমাদের সাথে থাকবার জন্য একজন মানুষকে সাথে রাখতে হয়েছিল।"
অবশেষে, ২০১৭ সালে তারা একজন নিউরোলজিস্টকে খুঁজে পেলেন যিনি, তার এই রোগকে স্টিফ পার্সন সিন্ড্রোম বলে নির্ধারণ করেছিলেন, যা হল অটোইমিউন রোগের বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি বিরল স্নায়বিক ব্যাধি।এর অর্থ হল, এই রোগে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজস্ব কোষগুলিকেই আক্রমণ করে বসে, এই রোগের কোনও চিকিৎসা নেই, কেবল এর লক্ষণ বা উপসর্গগু্লিকে অপসারণ করার চেষ্টা করা হয়।এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম,.লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে কেবলমাত্র গড়ে একজন এই স্টিফ পার্সন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হতে পারেন।
স্টিফ পার্সন সিন্ড্রোম গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তারা জিয়ার বলেন, “এই রোগ নির্ণয় করতে গড়ে সাত বছর লেগে যায়। সাত সাতটা বছর! তার মতে এটা খুবই অদ্ভুত একটা ব্যাপার।এর কারণ হল, এটি প্রায়শই মালটীপল স্ক্লেরোসিস, পারকিনসন, অথবা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি ভাবা হয় এবং রোগ নির্ণয় করতে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল হয়ে যায়”। তারা মেয়ো ক্লিনিকে কয়েকটি শারীরিক অনুশীলনের কোর্স করেছিলেন, যা তাকে এই রোগের প্রকোপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে সাহায্য করেছিল।
এদিকে, অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র তাসমানিয়ায়, Ultra-distance runner অথবা অতি-দূরত্ব রানার শেন জেমস, যার ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল তাসমানিয়ান ডেভিল, তিনি কিন্তু এই লক্ষণগুলি খুব ভাল জানতেন, কেননা তিনিও একই রোগে ভুগছিলেন।এই তাসমানিয়ান শয়তান ডেভিল যার বৈজ্ঞানিক নাম হল (সারকোফিলাস হ্যারিসিই)অস্ট্রেলিয়ার এক মাংসপরিজীবী প্রাণী এবং শেন জেমসকে এই ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল।
রানার শেন জেমস বলেন, "এই রোগে আপনি খুব ক্লান্ত বোধ করবেন, সবসময় একটা দু:সহ যন্ত্রণা অনুভব করবেন, এটি সপ্তাহের সাতটা দিন ২৪ ঘণ্টা ধরে, ঘরে বাইরে, আপনার সঙ্গে থাকবে এবং এটি নিয়ে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে, এবং আপনি নিজেও জানেন যে আপনার বাকি জীবনটা আপনাকে একে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে”।
তারা একটি বই লিখে এবং একটি অলাভজনক সংস্থা স্টিফ পার্সন সিন্ড্রোম রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে এই রোগ সম্বন্ধে আরও গবেষণার জন্য তহবিল সংগ্রহ করে ছিলেন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রোগ নিয়ে প্রাথমিক গবেষণার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন।তারা জিয়ার বলেন, “এই ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা হবে, রোগ নির্ণয়ের সেই সাত বছর সময়টিকে কমিয়ে আনা এবং এই রোগ যাতে আরও অল্প সময়ে সঠিকভাবে নির্ণয় যায়, তারই ব্যবস্থা করা"।
জেমস সারা জীবন আশা করে আসছিল যে কেউ সিনড্রোম নিয়ে গবেষণা শুরু করবে, এবং ফেসবুকের মাধ্যমে তারা জিয়ারের সাথে তার আলাপ হয়েছিল। সুতরাং, তিনি তারার এই ফাউন্ডেশনকে সহায়তা করার জন্য এবং সিন্ড্রোমের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, তাসমানিয়ার মধ্য দিয়ে ৮৮০ কিলোমিটার দৌড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আপনি সত্যিই এখন স্টিফ পার্সন সিন্ড্রোম রোগটি মোকাবিলায় এক উপায় খুঁজে পেয়েছেন, সুতরাং এটি আপনার উপর নির্ভর করে যে আপনি কি করবেন। এবং আমার ইচ্ছা ছিল লড়াই করা এবং সত্যই খুব কঠিন লড়াই করা। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে, কি কষ্টকর এই রোগ, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আপনি এই নিয়েই সব কাজ করে যাচ্ছেন"।
তারা জিয়ার বলেন, "আপনি যা করেছেন তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য এবং এর জন্য আমি চিরকাল আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব!"
৮৮০ কিলোমিটার দৌড়তে শেন জেমসের তিন সপ্তাহ সময় লেগেছিল, এবং তিনি যে ২০ হাজার ডলার সংগ্রহ করেছিলেন, সিনড্রোমের উপর গবেষণা তহবিলের জন্য সেই অর্থ তারা জিয়ারের ফাউন্ডেশনে পাঠানো হয়েছিল।