“বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভূত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর। পদে পদে তার বিপদ-শিহরণ-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি।”
এই কয়টি লাইন পরিচয় করিয়ে দেয় জনপ্রিয় চরিত্র মাসুদ রানার সঙ্গে। থ্রিলারপ্রিয় পাঠকদের কাছে এই লাইনগুলো ভীষণ পরিচিত। বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানা, যার মূল নায়ক “মাসুদ রানা” নামের এক রহস্যময় যুবক। বলা যায়, বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির অনেক পুরনো ও জনপ্রিয় সুপার হিরো মাসুদ রানা। তার আবেদন আজও পাঠকের কাছে একই রকম। দুঃসাহসী এই যুবককে ঘিরে গড়ে ওঠা সিরিজের গল্পগুলির প্রতি পদে পদে রয়েছে বিপদ ও মৃত্যুর হাতছানি।
মাসুদ রানা তৈরির নেপথ্যে
মাসুদ রানা চরিত্রের স্রষ্টা সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেন (জন্ম ১৯ জুলাই,১৯৩৬)। তিনি ১৯৬৬ সালে বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ধ্বংস-পাহাড়’ লিখে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন আধুনিক গোয়েন্দা চরিত্র ও রহস্য–রোমাঞ্চ কাহিনির সঙ্গে। সে সময় বইটি অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পায়।বইটি কাজী আনোয়ার হোসেনের আট–নয় মাসের পরিশ্রমের ফসল। তিনি এই রহস্য উপন্যাসের প্লটকে বাস্তবসম্মত করতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কাপ্তাই, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে। ১৯৬৫ সালে মোটরসাইকেলে করে তিনি ঘুরে এসেছিলেন চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি এবং তা কাহিনি সাজানোর জন্যই। এরপর সাত মাস সময় নিয়ে লেখেন ধ্বংস-পাহাড়। বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক স্পাই থ্রিলার এটি। ১৯৬৬ সালের মে মাসে বাজারে আসে বইটি। এরপর হইচই পড়ে যায়। প্রশংসা ও নিন্দা দুই-ই জোটে। একে তো বাঙালির গুপ্তচরবৃত্তি ও অ্যাডভেঞ্চার, তার ওপর যৌনতা।
বাংলাদেশে এরকম ঢঙে লেখা শুরু হয়নি তখনো। থ্রিলারের উপযোগী ভাষাও শিখতে লাগলেন তিনি। তৈরি করে নিলেন নিজস্ব একটা ধরন। নিজের লেখায় কাজী আনোয়ার হোসেন ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। বারবার কাটাকাটি করে তৃতীয়বারে দাঁড় করান পান্ডুলিপি। শেষ পর্যন্ত নিজের অসন্তুষ্টি নিয়েই ছাপার জন্য প্রেসে দিয়েছিলেন। এমনকি প্রুফ রিডিংয়ের সময়ও প্রচুর সম্পাদনা করেন। তবে পাঠক সাদরে গ্রহণ করে নেয় মাসুদ রানাকে। আর ওই কাহিনিই বাংলা রহস্য সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
দৈনিক সংবাদ তখন লিখেছিল, “উপন্যাসটির গতি আছে-ঘাত-প্রতিঘাত আছে। ভাষা সরল। সকলের পক্ষে সুখপাঠ্য হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।...আমাদের সাহিত্যে রহস্যোপন্যাসের সংখ্যা কম। লেখকের উদ্যম প্রশংসনীয়।”
পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা রহস্য সাহিত্যে রাজত্ব করে গেছে “মাসুদ রানা”। শুরুতে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির ছায়ায় বাঙালি এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন লেখক। পরে “মাসুদ রানা” বাংলা রহস্য সাহিত্যের জগতে একটি স্বকীয় স্থান তৈরি করে নেয়। প্রায় চার শ গুপ্তচরবৃত্তীয় কাহিনি নিয়ে সিরিজটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম দুটি গল্প মৌলিক রচনা হলেও এরপর ইংরেজি ও অন্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে লেখা শুরু হয়। যেহেতু এ ধরনের পশ্চিমা ধাঁচের গল্পের কোনো অভিজ্ঞতাই তখন বাংলাদেশে ছিল না, সেহেতু বিদেশি কাহিনির দ্বারস্থ হতে হয়েছে লেখককে।
মাসুদ রানা ও সহায়ক চরিত্র
সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর মাসুদ রানা, কাল্পনিক সংস্থা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স–এর সদস্য। তার সাংকেতিক নাম MR-9। এছাড়া রানা এজেন্সি নামক একটি গোয়েন্দা সংস্থাও মাসুদ রানা পরিচালনা করে থাকে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের আগের বইগুলোতে সংস্থাটির নাম উল্লেখ করা হতো পিসিআই বা "পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স" হিসেবে। সহায়ক চরিত্রে উল্লেখযোগ্য নাম মেজর জেনারেল রাহাত খান। তিনি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। তার তত্বাবধানে রানা নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। রানা তার বসকে এতটাই ভয় পান যে, প্রতিটি পর্বেই রানাকে যখন রাহাত খানের মুখোমুখি হতে হয়, তখন এরকম দুচার লাইনের বর্ণনা থাকে, “বুড়োর সাথে দেখা করতে এলে যা হয়, বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করেছে রানার। ঢোক গিলে, ঠোঁটে জিভের ডগা বুলিয়ে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল সে”।
সিরিজের জনপ্রিয় নারী চরিত্র সোহানা; কোটি পাঠকের হৃদয়ে সাহসী, সুন্দরী, আবেদনময়ী নায়িকা হিসেবে স্থান পেয়েছে। এছাড়া আরও রয়েছে সোহেল, সলিল, গিলটি মিয়া প্রমুখ। অন্যদিকে মাসুদ রানার চিরশত্রুদের তালিকায় আছে বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরী, উ সেন প্রমুখ।
মাসুদ রানা সিরিজের জনপ্রিয় বইগুলো
সিরিজের জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে আছে—ধ্বংস পাহাড়, ভরতনাট্যম, স্বর্ণমৃগ, দুঃসাহসিক, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, দুর্গম দুর্গ, শত্রু ভয়ঙ্কর, সাগর সঙ্গম, রানা! সাবধান!!, বিস্মরণ, রত্নদ্বীপ, জাল, এখনও ষড়যন্ত্র, প্রমাণ কই?, অদৃশ্য শত্রু, পিশাচ দ্বীপ, জিপসী, আমিই রানা, আই লাভ ইউ ম্যান, হ্যালো সোহানা। এছাড়াও এই সিরিজের আরও অনেক বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
নাটক–চলচ্চিত্রে মাসুদ রানা
মাসুদ রানা সিরিজের “বিস্মরণ” অবলম্বনে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। পরিচালনা করেন মাসুদ পারভেজ।
বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক “প্রাচীর পেরিয়ে”। নাটকের কাহিনি রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের “পিশাচ দ্বীপ” বইয়ের গল্প অবলম্বনে। নাট্যরূপ দেন আতিকুল হক চৌধুরী। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত এই নাটকটিতে মাসুদ রানার ভূমিকায় অভিনয় করেন সে সময়ের জনপ্রিয় মডেল তারকা নোবেল আর তার বিপরীতে সোহানার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত।
২০১৮ সালে মাসুদ রানা সিরিজ নিয়ে জাজ মাল্টিমিডিয়া একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেয়। এর বাজেট ধরা হয় ৫০ কোটি টাকা। তবে সিনেমাটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
মাসুদ রানার লেখকস্বত্ব নিয়ে বিতর্ক ও তার অবসান
জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের লেখকস্বত্ব নিয়ে এক সময় শুরু হয় বিতর্ক। লেখক শেখ আব্দুল হাকিম এর লেখক হিসেবে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করেন। উঠে আসে মাসুদ রানা সিরিজের নেপথ্যের কিছু কাহিনি। মাসুদ রানা যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন কাজী আনোয়ার হোসেন দেখলেন তার পক্ষে এককভাবে “রানা” লিখে প্রকাশনার ব্যবসা চালানো খুব কঠিন। এ অবস্থায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে “মাসুদ রানা” লেখানোর উদ্যোগ নেন তিনি। মানে সিরিজের বইগুলো এর স্রষ্টা ও মূল লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের নামেই প্রকাশিত হবে। তবে নেপথ্য থেকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করবেন বা লিখবেন দ্বিতীয় কেউ। মাসুদ রানার ক্ষেত্রে শেখ আব্দুল হাকিম ছায়ালেখক (শ্যাডো রাইটার) হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে বইগুলো লেখেন।
শুরুতে কোনো আপত্তি না থাকলেও ২০১০ সালে শেখ আবদুল হাকিম মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের মালিকানা স্বত্ব দাবি করেন। সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন শেখ আবদুল হাকিম। নয় বছরে এর কোনো সমাধান না হওয়ায় ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই তিনি কপিরাইট অফিসে অভিযোগ দায়ের করেন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আইনি লড়াই শেষে ২০২০ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় দেন। কপিরাইট অফিসের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরই হাইকোর্টে রিট করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। রিটের প্রাথমিক শুনানির পর ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট কপিরাইট অফিসের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রুল দেয়। ৯ ডিসেম্বর রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়। এরপর ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব পান শেখ আবদুল হাকিম। তার আগেই ২৮ আগস্ট প্রয়াত হন লেখক শেখ আব্দুল হাকিম।
এত তর্কবিতর্কের পরও মাসুদ রানার জনপ্রিয়তা কমেনি। বিশ্ব রহস্য সাহিত্যে এরকম আরও অনেক চরিত্র থাকলেও যেভাবে মাসুদ রানা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি পাঠকদের মন কেড়েছে, অন্য কোনো চরিত্রই তা পারেনি। তাই মাসুদ রানা চরিত্র ও তার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন যুগের পর যুগ অমর হয়ে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের আরেকটি বড় কৃতিত্ব সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে পেপারব্যাক বই প্রকাশের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল সেবা প্রকাশনী। এই প্রকাশনী পাঠকদের হাতে স্বল্পমূল্যে তুলে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সব উপন্যাসের অনুবাদ।
গত শতকের আশি–নব্বইয়ের দশকে কারও বাড়িতে গেলে সেখানে সেবা প্রকাশনীর একটি বইও থাকবে না, ভাবাই যেত না। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, কুয়াশা সিরিজ, ওয়েস্টার্ন, সেবা রোমান্টিক—কী বের হয়নি সেবা প্রকাশনী থেকে। বিভিন্ন রুচির পাঠক তার পছন্দের বইটি খুঁজে পেতেন সেবা থেকে। সেবার সবচেয়ে বড় কার্যক্রম ছিল ক্ল্যাসিকগুলোর অনুবাদ।