মাছে ভাতে বাঙালি – কথাটি বেশ পুরোনো। তবে বাঙালিদের ক্ষেত্রে কথাটি শতভাগ সত্য। বেশিরভাগ মানুষ এখনো ভাতের সাথে মাছ খেতেই পছন্দ করেন। শুধু স্বাদ নয় বিভিন্ন ধরণের মাছে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিগুণ, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন। আর তাই আজ আমাদের আয়োজনটি সাজানো হয়েছে দেশি মাছ ও এর পুষ্টিগুণ নিয়ে। পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকা ও বাংলা উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশি পাঁচটি মাছের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানাতে যাচ্ছি আমরা।
ইলিশ মাছঃ
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ ইলিশ খেতে পছন্দ করেন। স্বাদে অতুলনীয় ইলিশ কিন্তু পুষ্টিতেও ভরপুর।
ইলিশ মাছে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি। পাশাপাশি এই মাছে আছে সোডিয়াম, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড।
ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণঃ
১। ইলিশ মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এর কারণে মস্তিষ্ক ও চোখ ভাল থাকে।
২। ইলিশ মাছ “ভিটামিন ডি” এর ভালো উৎস। তাছাড়া ইলিশ মাছ খেলে ত্বক ও চুল ভালো থাকে।
৩। ইলিশে আছে প্রচুর তেল, যা আমাদের নার্ভ সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং রক্তসঞ্চালন বাড়াতে ভূমিকা পালন করে । পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডে থাকা খারাপ কোলেস্টেরল বের করে আমাদের সুস্থ রাখে ইলিশ মাছ।
৪. ইলিশ মাছ মানব দেহের রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। শরীরের নানা রকম ব্যথা (যদি থাকে) কমায়।
৫. ইলিশে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় আমাদের বিষণ্ণতা কমাতে সাহায্য করে ও স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে।
শিং মাছঃ
বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রিয় মাছ হিসেবে শিং এর বেশ কদর আছে। শিং মাছকে জিওল মাছ হিসেবেও চেনেন অনেকে। শিং মাছে পুষ্টিগুণ অনেক থাকায় এই মাছের চাহিদাও ব্যাপক। তাছাড়া, শিং মাছকে রুগীর খাদ্য হিসাবে অনেকেই বেঁছে নেন। বর্তমানে প্রায় সারা বছরই শিং মাছ বাজারেগুলিতে পাওয়া যায়। নদী-নালা, খাল-বিলের পাশাপাশি শিং মাছ এখন চাষও করছেন অনেকেই।
শিং মাছের পুষ্টিগুণঃ
প্রতি ১০০ গ্রাম শিং মাছে আছে ২২ দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন ,২ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম আয়রন ৬৭০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম।
শিং মাছের পুষ্টিগুণ অন্যান্য যে কোন মাছের তুলনায় বেশ বেশি। তাছাড়া, শিং মাছ খেতেও অনেক সুস্বাদু। এই মাছে আয়রন ও ক্যালসিয়ামের মতো খনিজ উপাদানের পরিমাণ অ্নেক বেশি থাকে। শিং এ থাকা আয়রন আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে ডাক্তাররা সেই রোগীকে শিং মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শিং মাছে থাকা প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম আমাদের হাড় ও দাঁতের জন্য উপকারি উপাদান। নিয়মিত শিং মাছ খেলে মায়ের দুধ ও শক্তি বাড়ে এবং শরীরের বাত কমে। কোন মা সন্তান প্রসবের পরে বুকের দুধ কম হলে তারা শিং মাছ খেতে পারেন।
কৈ মাছঃ
বাংলাদেশে জনপ্রিয় মাছগুলির মধ্যে “কৈ মাছ” অতি পরিচিত এক মাছ। পাশাপাশি সুস্বাদু মাছের তালিকায়ও কৈ অন্যতম। স্বাদের পাশাপাশি অনেক গুণেও গুণান্বিত এই কৈ মাছ।
আমাদের দেশে প্রধানত, দুই ধরনের কৈ মাছ পাওয়া যায়। দেশি কৈ এবং ভিয়েতনামী বা থাই কৈ, যা চাষী কৈ নামেও পরিচিত। পুষ্টিগুনের দিক দিয়ে উভয় মাছই প্রায় সমান। তবে দেশি কৈ মাছে তুলনামূলকভাবে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ কিছু বেশি। ১০০ গ্রাম কৈ মাছে পাওয়া যায় শক্তি ১৩৯ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ১৭.৫ গ্রাম, ফ্যাট ৭.৭ গ্রাম, শর্করা ০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪১০ মি.গ্রা, ম্যাঙ্গানিজ ৫৩ মি.গ্রা, ফসফরাস ৩৯০ মি.গ্রা, পটাশিয়াম ২১৪ মি.গ্রা, ভিটামিন এ ২১৫ মাইক্রোগ্রাম এবং ভিটামিন ডি ৮৫.৬০ আই ইউ।
কৈ মাছের উপকারিতাঃ
১। কৈ মাছে আছে দশটি প্রয়োজনীয় আম্যাইনো এসিড, যা শিশুদের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শুধু শিশুই নয়, যেকোন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই ১০ টি অ্যামাইন এসিড।
২। কই মাছ দৃষ্টিশক্তির উন্নতি সাধন করে। এটি ভিটামিন এ ও ভিটামিন ডি এর একটি ভালো উৎস। কই মাছ হাড় ও দাঁতের গঠনেও ভূমিকা রাখে।
৩। কৈ মাছে আছে প্রচুর পরিমাণে DHA, যা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে খুবই প্রয়োজনীয়। এছাড়া, এই মাছ হৃদরোগ ঝুঁকি কমায় এবং মস্তিষ্ককে সুরক্ষা প্রদান করে অ্যালঝেইমার রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।
৪। কৈ মাছ সহজপাচ্য। তাই সকল বয়সের মানুষ এই মাছ সহজে খেতে পারে। কোন রোগে এটি কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না।
৫। কৈ মাছের কাঁটায় খনিজ লবণ অধিক পরিমাণে থাকে এবং এর মাথা ও চোখে থাকে DHA।
কাচকি মাছঃ
দেশি মাছগুলির মধ্যে জনপ্রিয় আরেকটি মাছ হলো কাচকি মাছ। বাংলাদেশে এর চাহিদা অনেক। স্থানীয় বাজারের প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায় এই মাছ। কাচকি মাছে প্রধান উৎস নদী।
কাচকি মাছের উপকারিতাঃ
কাচকি মাছে পুষ্টিগুণ ব্যাপক। কাচকি মাছ খেতে হবে ভাল ভাবে চিবিয়ে, তাহলে তা থেকে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম পাওয়া যাবে। কাচকি মাছের অসম্পৃক্ত চর্বি যা শরীরকে রক্ষা করতে পারে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ রোগ থেকে মুক্তি দেয় এই মাছ। পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকরা কাচকি মাছ নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখার পরামর্শ দেন। ছোট মাছে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম।
প্রতি ১০০ গ্রাম কাচকি মাছে আছে ১২.৭ গ্রাম প্রোটিন আছে। আছে ৩.৬ গ্রাম চর্বি, ৪৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.৮ মিলিগ্রাম আয়রন। এই মাছ কোটারও ঝামেলা নেই, ধুয়ে বেছে খেয়ে নেওয়া যায়।
পাবদা মাছঃ
পুষ্টিকর ও সুস্বাদু মাছের মধ্যে পাবদা মাছ বেশ উল্লেখযোগ্য। পাবদা মাছ সাধারণত নদী, বিল এবং হাওড় অঞ্চলে পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভাবে পুকুর ও বায়োফ্লক পদ্ধতিতে এই মাছ চাষ করা হচ্ছে। এই মাছটির পুষ্টি উপাদান বেশি থাকায় এর চাহিদা দিন দিন বাজারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । তাই প্রায় সারা বছরই পাওয়া যাচ্ছে পাবদা মাছ।
পাবদা মাছের পুষ্টিগুণঃ
পাবদা মাছের পুষ্টিগুণ প্রচুর। আমাদের দেহে প্রচুর পরিমান আমিষের প্রয়োজন হয়। তার অধিকাংশ আমরা পাবদা মাছ থেকে পেতে পারি। পাবদা মাছে আছে ক্যালসিয়াম,ফসফরাস,ও লৌহ।
প্রতি ১০০ গ্রাম পাবদা মাছে আছে আমিষ ১৯.২ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ১১৪ কিলোক্যালরি, চর্বি ২.১ গ্রাম, ফসফরাস ২১০ মি. গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩১০ মি. গ্রাম, লৌহ ১.৩ গ্রাম, কোলিন ১০১৮ একক এবং আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড।
পাবদা মাছে থাকা প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম আমাদের শরীরের দাঁত এবং হাড় গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
পাবদা মাছ আমাদের শারীরিক দুর্বলতা দূর করে থাকে । হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে করে দেয় এবং আমাদের দৈহিক গঠনে সাহায্য করে থাকে।