সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, "বিদায়ী নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট নির্বাচন কমিশন। এইভাবে এক তরফা চললে আগামীতে কেউ ক্ষমতা ছাড়বে না। মানুষের ভোটের অধিকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে।" ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির এই প্রতিনিধি কাজ করেন মানুষের ভোটাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে।
প্রশ্ন: আগামী নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন সংস্কার, গত পাঁচ বছর যারা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিদায়, এই বাস্তবতায় আগামী নির্বাচন কমিশন (ইসি) কীভাবে গঠিত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আগামী দিনে কেমন নির্বাচন কমিশন প্রত্যাশা করছেন? কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দিকে যেতে পারে?
উত্তর: নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের জন্য অনেকগুলো স্টেক হোল্ডার বা অংশীজন থাকে। যার মধ্যে নির্বাচন কমিশন হলো সবচেয়ে বড় অংশীজন। নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। বুঝতে হবে এটা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কাজেই এই প্রতিষ্ঠানে সঠিক ব্যক্তি নিয়োগ পাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি একটি আইন করে, এবং সেখানে একটি পদ্ধতি সুস্পষ্ট করা থাকবে। এই আইনের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কয়েকজন ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এই লক্ষ্যে আমরা একটি আইনের খসড়া করেছি। এবং মাননীয় আইনমন্ত্রীর কাছে সেই খসড়াটি হস্তান্তর করেছি। আমরা বিশ্বাস করি যে, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, আইনের বিধি-নিষেধের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যদি কয়েকজন ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে। আগামীতে আমরা একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পেতে পারি।
প্রশ্ন: কোন ধরনের ব্যক্তিকে ইসিতে নিয়ে আসলে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে?
উত্তর: সৎ, যোগ্য এবং একজন সাহসী ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। যাদের (অংশীজনের) মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে নির্বাচন কমিশনে। সেই ধরনের ব্যক্তিকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে আমরা বরাবরই সোচ্চার। সেই লক্ষ্যেই আমরা একটা আইন প্রণয়নের দাবী করছি।
প্রশ্ন: অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে চাই, আপনি কি মনে করেন আপনাদের দাবীর পক্ষে সরকার সাড়া দেবে বা সেই লক্ষ্যে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে?
উত্তর: অতীতের অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়, এবং ইতিবাচক নয়। আমরা মাননীয় আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যখন দেখা করেছি, তখন তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন। এবং বলেছেন, এই ক’টা আইন হওয়া দরকার। কিন্তু তিনি বলেছেন যে সময় কম, কারণ এটা এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন যাতে সংসদকে সংশ্লিষ্ট করা বা যুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমাদের প্রশ্ন হলো যদি এটা গুরুত্বপূর্ণ আইন হয় তাহলে ওনারা এটা আগেই তো শুরু করতে পারতেন! এছাড়াও অবশ্যই এখানে সংসদকে যুক্ত হতে হবে। কিন্তু তার আগে অধ্যাদেশ জারি করে আইনের প্রয়োগ করা যেতে পারে। আইনটি অত্যন্ত সাধারণ! সহজ আইন এবং দুই-চার পৃষ্ঠা সর্বোচ্চ। আশা করছি সরকার আগামী তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তাবিত খসড়া আলাপ-আলোচনা করে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করে পরবর্তী সংসদে আইনটি উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু তিনি বলেছেন যে, সংসদকে যুক্ত করা হবে না। কিন্তু পক্ষান্তরে তারা যা করবেন যে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে অতীতের মতো তারা নিয়োগ দেবেন। সেখানে সংসদের কোনো রকমের সম্পৃক্ততা নেই। এটি একটি স্ববিরোধী যুক্তি। আমি মনে করি যে তারা একটা আইন প্রণয়ন করে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগ দেবেন। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারের সদিচ্ছা। সরকার যদি ইচ্ছা করে তাহলে তা করতে পারে। এবং সরকার যদি চায় বিতর্কিত কমিশনের বিপরীতে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে একটি কমিশন গঠন করতে পারে।
প্রশ্ন: বর্তমান যে বাস্তবতা, সে বাস্তবতায় সরকার সেদিকে যাবে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে আপনার কাছে কেন এমন মনে হচ্ছে?
উত্তর: সরকার কী করবে না করবে সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে আমরা যেটা ইঙ্গিত পেয়েছি যে সরকার অতীতের পথেই হাঁটবে। এবং তারা অতীতের মতোই কমিশন গঠন করবে। আমাদের দায়িত্ব হলো এটা যে সঠিক পথ নয় সেটা বাতলে দেওয়া। সরকার যেন সঠিক পথে হাঁটে সে লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। আমরা সে কাজটাই করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, এবং সরকার সদিচ্ছার পরিচয় দেবে। এবং জনগণের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে।
প্রশ্ন: গত পাঁচ বছরে বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর: দুর্ভাগ্যবশত এই নির্বাচন কমিশনের অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত। বর্তমান সিইসি মহোদয়ের সঙ্গে আমার বহুদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তা সত্ত্বেও আমি বলব, বিদায়ী নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন হয়তো আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট নির্বাচন কমিশন। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এই কথাগুলো বললাম।
প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন নির্বাচন নিয়ে কাজ করছেন, আগামী নির্বাচন কমিশন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
উত্তর : আমরা জাতি হিসেবে অনেকগুলো সংকটের মুখোমুখি। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গেছে। আমাদের অনেকগুলো অধিকার সংকুচিত হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাদের দেশে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রদায়িক মানসিকতা নষ্ট হওয়ার পথে, যার ফলে সাম্প্রদায়িকতা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। আমাদের সুশাসনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছি। এসব সংকটের মুখোমুখি আমরা গোটা জাতি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির চরম অবক্ষয় ঘটেছে। আমরা ফায়দা নেওয়া রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছি। এমনটা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কেউ ক্ষমতা ছাড়বে না। এই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে আমরা আশা করব আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাহসী পদক্ষেপ নেবেন। এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে তিনি অগ্রসর হবেন। সেই লক্ষ্যে সঠিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। একটি নতুন মাইলফলক উন্মোচিত হবে।