অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

 
বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল বন্ধ; সমালোচনায় মুখর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল বন্ধ; সমালোচনায় মুখর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম


ফাইল ছবিঃ বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল। ২০২৫।
ফাইল ছবিঃ বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল। ২০২৫।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রবিবারে অমর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্থাপিত দুটি স্টল বন্ধ করে দেয় বাংলা একাডেমি। বন্ধ হওয়া ওই দুটি স্টলে নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্র্যান্ড ‘স্টে সেইফ’-এর স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করা হচ্ছিল।

একইদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে স্টল বন্ধের কারণ ব্যাখ্যা করে লেখা একটি চিঠি। বইমেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ‘ড্রিমার ডংকি’র পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী রাকিব হাসানের লেখা সেই চিঠিতে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের স্বাক্ষর ছিল।

১৪ ফেব্রুয়ারিতে লেখা চিঠিটি ‘স্টে সেইফ’-এর মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ কতৃপক্ষকে পাঠানো হয়। এবং সেখানে উল্লেখ করা হয়, ১১ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে একাধিক ‘ইসলামিস্ট গ্রুপ’ স্যানিটারি ন্যাপকিনকে গোপন পণ্য আখ্যা দিয়ে এই পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধের দাবী তুলেছে। এমন দাবী কেন্দ্র করে মব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল বন্ধ করার কথা বলা হয়।

চিঠিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের স্টল কেন তুলে দেয়া হলো, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। অনেকে এই পণ্যকে ‘গোপন’ আখ্যা দেয়ার নিন্দা জানান।

সমালোচনার প্রেক্ষিতে ১৬ তারিখে বাংলা একাডেমি একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয় নীতিমালা লঙ্ঘন করার কারণেই মূলত বইমেলায় স্টল দুটি বন্ধ রাখা হয়েছে। বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার সরবরাহ করার কথা ছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু অনুমতি না নিয়ে তারা এসব পণ্য বিক্রি করছিল, যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এদিকে সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত দুই দিনে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার মতে, নারীরা ইনসিকিউরড হচ্ছে, এমন একটি বার্তাই দেয় এ ধরণের ঘটনা। তিনি লিখেছেন, “অভ্যুত্থানের পরে মেয়েদের সার্বিকভাবে ইনসিকিউরড হওয়া কোনো ভালো লক্ষণ না। অভ্যুত্থানে মেয়েদের যে ধরনের এক্টিভ পর্টিসিপেশন ছিল এটা বর্তমানে নীতি নির্ধারকদের মানসপট থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন জনে জনে ধরে বোঝাতে হয়- 'মেয়েরাও তো ছিল'

অথচ এই আন্দোলন এমনও দিন ছিল যেদিন মিছিল থেকে মনে হতো- 'মেয়েরাই তো ছিল'”

কবি ও লেখক অর্জয়িতা রিয়া লিখেছেন, “শুধু বইমেলা না, মেয়েরা নিত্যদিন যেসব জায়গায় যায়—প্রতিটা জায়গায় স্যানিটারি প্রডাক্ট থাকা দরকার। স্কুল, কলেজ, আদালত, হাসপাতাল, শপিংমল, অফিস, নারীদের জন্য নির্ধারিত পাবলিক টয়লেট প্রতিটা জায়গায়।

পিরিয়ডের মত একটা সহজ স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে কারো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য 'ট্যাবু' বানানো চলবে না। পিরিয়ড নারীর শারীরিক ক্ষমতার অপরিহার্য অংশ, যেইটা মানবজন্মের ধারাবাহিকতার ভিত্তি তৈরি করে।”

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও অধিকার কর্মী সাধনা মহল এই ঘটনার পেছনে বিগত সরকারের প্রতি অনুগতদের হাত আছে বলে মনে করছেন। তিনি লিখেছেন, “খুনি "কওমি জননী"র সন্তানরা বইমেলায় হাইজিন প্যাড রাখতে দেবে না। আযম ভাই, রাজি হবেন না। বাকিটা জুলাইয়ের মেয়েরা বুঝে নেবে।”

উন্নয়ন কর্মী ফেরদৌস আরা রুমী লিখেছেন, “বাংলা একাডেমির উচিত ছিল একটার জায়গায় আরো দুইটা স্টল বসিয়ে তাদের সমুচিত জবাব দেয়া। স্যানিটারি ন্যাপকিন গোপন পণ্য। তো ওদের মেলায় আসার দরকার কি?”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা স্যানিটারি প্যাডের ওপর করা কিছু জার্মানির কয়েকটি আর্টওয়ার্ক শেয়ার করে লিখেছেন, “'গোপন পণ্যের' গোপন রাখার প্রচেষ্টায় মনে পড়ল, নারী সত্তার এই সত্য শিল্পীরা অতিক্রম করে!”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক রায়হানা শামস ইসলাম এই ঘটনা নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে সমাজে পিরিয়ড সংক্রান্ত ধারণা নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন: “বাংলা একাডেমিতে ঠিক কী ঘটেছে বা কেন ঘটেছে, আমি জানি না। সুতরাং সরাসরি মন্তব্য করতে পারলাম না। শুধু জানি, আমাদের সমাজে মেয়েদের পিরিয়ড সংক্রান্ত ব্যাপারে সমাজের মানসিকতা ও আচরণের ভেতরে ভারসাম্যপূর্ণ সাবালকত্বের বড় অভাব আছে।”

লেখক মারুফুল আলম চলতি মাসে আরো দুজন কবি ও প্রকাশককে ঘিরে গড়ে ওঠা বিতর্কের সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে মিলিয়ে দেখছেন। তিনি লিখেছেন, “শতাব্দি ভব; সোহেল হাসান গালিব; স্যানিটারি ন্যাপকিন; তারপর?”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শ্যামলী শীল লিখেছেন, “শুধু বইমেলা কেন, এখন থেকে যেকোনো পাবলিক উৎসব আয়োজনে "ইমার্জেন্সি স্যানিটারি ন্যাপকিন কর্নার” চাই।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম একাডেমীর পরিচালককে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে একটা ফান্ড ম্যানেজ করে দেন। দেশের সব নারীরা জরায়ু অপারেশন করে ফেলি। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি! জরায়ু নাই তো মাসিকও নাই!”

শিল্পী ও শিক্ষার্থী কেয়া চৌধুরী জুঁই লিখেছেন, “স্যানিটারি ন্যাপকিন আমাদের সংস্কৃতি হইতে পারে না। স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার কোণায় জামার নিচে পুরানো ত্যানা শুকানো, আর সেই ত্যানা দিয়া পারিবারিক ব্ল্যাক ম্যাজিক করাই আমাদের সংস্কৃতি।”

এদিকে আইনবিদ, লেখক ও অনুবাদক মিল্লাত হোসেন বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিন না রাখার পক্ষে নিজের মতামত জানিয়েছেন। তার মতে, “শুধু বই কেনার মতাদর্শ নিয়েই মেলায় আসুন, বাকি সব ইডিওলজি বাড়িতে রেখে আসাই বিধেয়। অমর একুশে বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি চাই না- না, না না!

কারণ, এটা বইমেলা- স্যানিটারি ন্যাপকিন মেলা না। বই মেলায় ছেলেরা যেমন নিরোধক কিনতে যায় না, মেয়েরাও ন্যাপকিন কিনতে যায় না। ছেলে-মেয়ে উভয়েই বই কিনতে-দেখতে অথবা স্টল থেকে বই তুলে নিয়ে গভীর মনযোগের সাথে পড়ছে, এমন একটা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে যায়।

প্রচারের স্বার্থে কোনো কোম্পানি যদি ফ্রি ন্যাপকিন বা মাস্ক দিতে চান দিতে পারেন, ব্যস। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিই ফ্রি স্পন্সর জোগাড় করে দিতে পারে। একাডেমি নিজেদের পয়সায় দিতে চাইলে, তাও পারে।”

নৃবিজ্ঞানী ও লেখক নাসরিন খন্দকার এই ঘটনার সমালোচনা করে লিখেছেন, “বইমেলায় টয়লেটই বা থাকবে কেন? মানুষজন গোপন অঙ্গ বাসায় খুলে রেখে বইমেলায় যাবেন।”

চিকিৎসক ও লেখক নাদিয়া জান্নাত এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে লিখেছেন, “২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের ৭৬ শতাংশ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে শুকনো কাপড় অথবা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।

…দেশের ৭৩ শতাংশ নারীর কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা রীতিমত বিলাসিতা। ন্যাপকিনের উচ্চমূল্যের জন্য নারীরা ঝুঁকির কথা চিন্তা না করে অনায়াসে শুকনো কাপড়কে বেছে নিচ্ছেন।

…২০২৫ এর মতো একটি সময়ে এসে আমরা সচেতনতা নিয়ে আলাপ করতে পারতাম। স্যানিটারি ন্যাপিকিনের পাশাপাশি মেন্সট্রুয়াল কাপ, ট্যাম্পন নিয়ে কথা বলার সময় এখন। কিন্তু এমন একটি সময়ে এসে ন্যাপকিনকে গোপন পণ্য বলা হচ্ছে, ন্যাপকিনের প্রকাশ্য প্রদর্শনী বা বিক্রি বন্ধ করতে বলা হচ্ছে।”

XS
SM
MD
LG