আর্জেন্টিনার একটি আদালত ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় তার ভূমিকার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান কমান্ডার সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
বৃহস্পতিবার ঘোষিত আদালতের সিদ্ধান্তে অং সান সু চি এবং ২২ জন সামরিক কর্মকর্তা সহ আরও দু'জন বেসামরিক নেতার নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
২০২১ সালে অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করার পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নেতৃত্ব দেওয়া মিন অং হ্লাইংকে কেন্দ্র করে বুয়েনস আয়রেসের আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি জারি করেছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস দমন-পীড়নের সাথে জড়িত পরিকল্পিত হত্যা, নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতা। এই রাজ্যটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত।
মিয়ানমারের জান্তা এখনো আর্জেন্টিনার আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ভিওএ-র প্রশ্নের জবাবে, জান্তার মুখপাত্র জেনারেল জাও মিন তুন মিয়ারমারের উপর আর্জেন্টিনার আইনগত কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন।
মুখপাত্র ভিওএ-র একটি প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় জান্তার ভাইবার প্রেস গ্রুপে বলেন, “আর্জেন্টিনা কি মিয়ানমারকে আদৌ চেনে? মিয়ানমার সরকার আর্জেন্টিনাকে চেনে। যদি আর্জেন্টিনা মিয়ানমারকে আইনগতভাবে সমালোচনা করতে চায়, তাহলে তাদের মিয়ানমারের উপর বিচারিক কর্তৃত্ব থাকতে হবে। আমি পরামর্শ দিচ্ছি, প্রথমে আপনার নিজেদের খালি বিচারিক পদগুলি পূর্ণ করার দিকে মনোযোগ দিন।”
২০১৯ সালে সর্বজনীন বিচারিক এখতিয়ারের নীতির অধীনে মামলাটি দায়ের করা হয়। কিন্তু, মিয়ানমারের জান্তা অব্যাহতভাবে আর্জেন্টিনার সম্পৃক্ততা প্রত্যাখ্যান করে আসছে, এই মর্মে যে বিদেশি আদালতগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নেতাদের বিচার করার কোনো কর্তৃত্ব রাখে না। সর্বজনীন বিচারিক এখতিয়ারের নীতিটি জাতীয় আদালতকে গুরুতর অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি দেয়।
আইনী প্রচেষ্টা, আদালতের সিদ্ধান্ত
২০১৯ সালে প্রাথমিক অভিযোগ দায়েরকারী বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউ.কে. (ব্রুক) আদালতের রায়কে ন্যায়বিচারের বিজয় হিসেবে প্রশংসা করেছে।
২০১৭ সালে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা জনসংখ্যার বিরুদ্ধে একটি নৃশংস হামলা শুরু করে। রাজ্যটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এই হামলা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পুলিশের চৌকিতে হামলার পর শুরু হয়।
সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়ামূলক অভিযানে, গণহত্যা, যৌন সহিংসতা এবং গ্রামগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ফলে ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই সামরিক বাহিনীর অভিযানগুলিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
গত বছরের শেষের দিকে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য মিন অং হ্লাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলেও, অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতের সিদ্ধান্ত বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, ব্রুক গণহত্যার সাথে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কিত প্রমাণ উপস্থাপন করে শুধুমাত্র সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের পরোয়ানার জন্য অনুরোধ করে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এবং মিয়ানমারের কার্যত নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অং সান সু চি বা সাবেক বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হটিন কিয়াও-এর বিরুদ্ধে কোনোও প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
কিন্তু, ২০২৪ সালের জুন মাসে আর্জেন্টিনার প্রসিকিউটর তাদের অন্তর্ভুক্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেন। তখন ব্রুক আদালতকে বার্মার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করে, কিন্তু আদালত এই অনুরোধটি খারিজ করে দেয়।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে।
পরোয়ানার প্রভাব
মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি এবং মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, আর্জেন্টিনার মানবাধিকার আইনজীবী টমাস কুইন্টানা, আদালতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
কুইন্টানা বলেন, যে রায়টি দেওয়া হয়েছে তা আইনগত কৌশল এবং সে সময় উপলব্ধ প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ছিল।
গণহত্যায় অং সান সু চির ভূমিকা এখনও আর্জেন্টিনার আদালতের তদন্তের অধীনে রয়েছে। প্রথমে আদালত সহিংসতার সরাসরি অপরাধী মিন অং হ্লাইংসহ সামরিক নেতাদের উপর মনোযোগ দিলেও, পরবর্তীতে প্রসিকিউটরদের সাথে একমত হয়ে তারা বেসামরিক নেতাদের দায়িত্বও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়।
আর্জেন্টিনার আদালতের সিদ্ধান্তের ফলে ইন্টারপোলের একটি "রেড নোটিশ" জারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যাতে বিশ্বব্যাপী মিন অং হ্লাইং এবং মিয়ানমারের অন্যান্য সামরিক নেতাদের আটকের জন্য আবেদন জানানো হবে।
কুইন্টানা বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটিতে অং সান সু চিকে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে প্রতিবন্ধকতার পরেও পরোয়ানাটি রোহিঙ্গা জনগণের পক্ষে একটি শক্তিশালী প্রতীকী রায়। তিনি বলেন, এটি বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়াতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।