প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে তাদের দু দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে “ন্যায্যতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার” সংকল্প ব্যক্ত করেন । তিন বলেন এই সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং সম্ভবত শুল্ক বৃদ্ধি পাবে।
“ভারত যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করবে, আমরাও সেই পরিমাণই আরোপ করবো,” এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন। “সুতরাং সত্য বলতে কি, তারা কত শুল্ক ধার্য করলো, তাতে আমাদের আর কিছু যায় আসে না।”
তিনি আরও বলেন, “ আমরা মূলত সমান সুবিধা পেতে চাই।”
বাণিজ্য উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ট্রাম্পের উদ্বেগ আমলে নিচ্ছে এমনটা প্রদর্শন করার পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি ভারতকে “অনেক বড় শুল্ক অপব্যবহারকারী” দেশগুলোর তালিকাভুক্ত করেছেন। গত মাসে মোদীর সাথে ফোনালাপে ট্রাম্প ন্যায্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য উত্তেজনা এড়াতে চায় নয়াদিল্লী। এ মাসের শুরুতে তারা ঘোষণা দেয়, তারা এমন কিছু পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমাবে যা আমেরিকার রপ্তানিকারকদের জন্য লাভবান হবে; যেমন উচ্চমূল্যের মোটরসাইকেল ও গাড়ি।
আগের মতই মোদী ট্রাম্পের প্রশংসা করেন এবং প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয় উক্তি “মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” বা “ম্যাগা’র প্রতিধ্বনি তুলে বলেন তিনিও “মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেইন” বা “মিগা” অর্জন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে মোদীর প্রশংসা করে বলেন, ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে ভাল।
ভারতীয় ফেরারিকে প্রত্যর্পণ
ট্রাম্প বলেন তিনি ২০০৮ সালে মুম্বাই আক্রমণের একজন পরিকল্পনাকারীকে প্রত্যর্পণ করবেন। মনে করা হচ্ছে তিনি তাহাউর হোসেন রানা প্রসঙ্গে বলছিলেন, যিনি ডেনমার্কের একটি পত্রিকার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দোষী সাব্যস্ত হন।
“তাকে বিচারের সম্মুখীন করাতে ভারতে পাঠানো হচ্ছে,” ট্রাম্প বলেন। পরে তিনি যোগ করেন, “আমরা তাকে অবিলম্বে ভারতে ফেরত পাঠাচ্ছি।”
ট্রাম্প বলেন আরো লোককে প্রত্যর্পণ করা হবে।
ট্রাম্প আরও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতে সামরিক সাজসরঞ্জাম বিক্রি শিগগিরই “ কয়েক মিলিয়ন ডলার” বৃদ্ধি করবে। আর এর ফলে শেষ পর্যন্ত ভারতে এফ-৩৫ স্টেলথ জঙ্গি বিমান দেয়া সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত এই যুদ্ধ বিমান চেয়ে আসছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ভারতের অনুকূলে ৫ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২০২৩ সালে ছিল ১৯ হাজার ১০ কোটি ডলার । ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগের হিসেবে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির পরিমাণ ছিল সাত হাজার কোটি ডলার, অন্যদিক আমদানির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার কোটি ডলার।
গত মাসে ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর মোদী হচ্ছেন চতুর্থ বিদেশী নেতা যিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসলেন। এর আগে এসেছিলেন ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, জাপানের ইশিবা এবং জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ।
অভিবাসন উভয় দেশের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয়।ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতামূলক ব্যবহার করেছে এবং বলেছে, তারা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত।
সংবাদ সম্মেলনে মোদী বলেন যেসব ভারতীয় নাগরিক বেআইনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তাদের ভারত ফেরত নেবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, এই বেআইনি অভিবাসনের পেছনে মানব পাচারকারী চক্র জড়িত আছে।
প্রতিরক্ষা সাজসরঞ্জাম বিক্রি
এর আগে ভয়েস অফ আমেরিকার অ্যানিতা পাওয়েল জানানঃ বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানান । তাঁর প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সামগ্রী ও জ্বালানি বিক্রি বৃদ্ধি করতে চাইবেন এবং ওই অঞ্চলে চীন যখন তার পেশী শক্তি প্রদর্শন করছে তখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটন তার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চায়।
“আমাদের লক্ষ্য হবে ভারতে প্রতিরক্ষা সাজসরঞ্জাম বিক্রি বৃদ্ধি করা যাতে এটা নিশ্চিত করা যায় যে তারা আমেরিকান প্রযুক্তির ব্যবহারকে অগ্রধিকার দিচ্ছে," বৃহস্পতিবার সকালে এক ব্রিফিং’এ একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সংবাদদাতাদের বলেন। সাংবাদিকদের ব্রিফিং’এর সময় কর্মকর্তাটির নাম জানানোর রেওয়াজ নেই।
“প্রেসিডেন্ট আমেরিকার জ্বালানি বিশ্বের সর্বত্রই রফতানি করতে চান এবং আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ আমদানিকারক হিসেবে ভারতকে অগ্রাধিকার দিতে চায় যাতে তারা তাদের অর্থনীতিকে আরও মজবুত করতে পারে," কর্মকর্তা বলেন।
"দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে এবং ন্যায় সঙ্গত বানিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করতে আমরা আমাদের মধ্যকার বানিজ্যিক সম্পর্ককে কি ভাবে উন্নত করতে পারি সে সব বিষয় নিয়ে দুই নেতা আলোচনা করবেন।"
মোদী সামাজিক মাধ্যম এক্স’এ বলেন যে তিনি “যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের দিকে এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কম্প্রিহেনসিভ গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ গড়ে তোলার দিকে চেয়ে আছেন। আমাদের জনগণের কল্যাণের জন্য এবং আমাদের এই গ্রহের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দুটি দেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।"
বিশ্লেষকরা বলছেন এই আলোচনায় চীনও প্রাধান্য পাবে এবং হোয়াইট হাউস আরও জানিয়েছে যে এই দুই নেতা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সমন্বয়ে গঠিত কোয়াডকে আরও উন্নত করার বিষয় নিয়েও আলোচনা করবেন।
ইউ.এস ইনস্টিটিউট অফ পিস’এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড্যানিয়েল মার্কে বলেন, “২০২০ সালের গালোয়ান উপত্যকার দূর্ঘটনার পর ভারত-চীন সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে।" ওই ঘটনায় বিতর্কিত অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং তা “নিঃসন্দেহে নতুন দিল্লিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের ব্যাপারে আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে”।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যশনাল ন্টাডিজের ভারত বিষয়ক বিশ্লেষক বিক রসো ভারতের লক্ষ্য সম্পর্কে ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে কথা বলেন।
“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন বিশ্বের বিরুদ্ধে এক ধরণের বানিজ্যিক লড়াই শুরু করছেন, এতে অন্য অনেক দেশের চাইতে ভারতের বড় রকমের ঝুঁকি রয়েছে এবং তারা এটা নিশ্চিত করতে চায় যে এই সম্পর্ক যাতে স্থিতিশীল থাকে," তিনি বলেন। "সুতরাং তারা এই জায়গায় আসতে চায়। তারা সামনে থাকতে চায়। তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে সব জিনিষ ক্রয় করতে পারবে সে সব নিয়ে কথা বলতে চায়। তারা সেই সব নীতি নিয়ে কথা বলতে চায় যার নিস্পত্তি তারা করতে পারে এবং সব কিছু যাতে স্থিতিশীল থাকে সেটা নিশ্চিত করতে চায়,কারণ এই সম্পর্ক আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
এই প্রতিবেদনে ভয়েস অফ আমেরিকার প্যারিস হুয়াং কিছু তথ্য সরবরাহ করেছেন, এবং দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।