ঢাকার ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’ প্রথমে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের পর ভবনটির সিংহভাগ ক্রেন ও বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে একদল বিক্ষোভকারী। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনেও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সারাদেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের বাড়িতেও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন-ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে ঘটনার শুরু হয়। এরপর ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি-দলের কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের একাধিক ঘটনা ঘটে জানায় স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।
নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ফেসবুক পেইজে ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। আর এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ৫ আগস্টের পর দ্বিতীয় দফায় ঢাকাসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা শুরু হয়।
স্থানীয় গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন জেলার সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানা যায়, ঢাকা ছাড়াও খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, সিলেট, নোয়াখালী, ফেনী, রংপুর শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
৫ ফেব্রুয়ারি রাতে খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত শেখ হাসিনার আত্মীয় বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের আলোচিত ‘শেখ বাড়িতে’ ভাঙচুর করে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
ওইদিন রাতে বিক্ষোভকারীরা শেখ পরিবারের আরেক আত্মীয় বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর নগরীর কালীবাড়ি রোডে বাসভবন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।
৫ ফেব্রুয়ারি রাতেই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর বরিশালের জীবনানন্দ দাশ সড়কের বাসভবন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। বর্তমানে এই রাজনীতিবিদ কারাগারে আছেন।
একইদিন রাতে বিক্ষোভকারীরা আরেক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ভোলা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভোলার গাজীপুর সড়কে অবস্থিত বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল এবং তার ভাই পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান মালেকের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা।
একইদিন রাতে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাড়িতে ভাঙচুর এবং এক্সকাভেটর দিয়ে বাড়ির গেট ও বাড়ির দেয়াল গুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে ৫ আগস্ট ওই বাড়িতে লুটপাট হয়।
ভাঙচুরের ঘটনার পর স্থানীয় গণমাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুষ্টিয়া জেলার সদস্য সচিব মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “স্বৈরাচারীরা রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে। এই বাংলাদেশে তাদের জায়গা নেই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম চলবেই।”
৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে কুমিল্লার আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের তিনতলা বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে স্থানীয় একটি গোষ্ঠী। এরআগে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও ওই বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছিল।
একইদিন রাতে নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ব্যানারে একদল।
৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একাধিকবারে সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটের বাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী- হামলাকারীরা বাড়ির বিভিন্ন আসবাবপত্র, ছাদের রেলিংয়ে ও সামনে থাকা পোড়া একটা গাড়িতে আগুন দেয়।
এদিন রাতে ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের বারাহীপুর এলাকায় বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনার বিষয়ে ফেনী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, “খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে।"
৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজশাহীর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাঘার আড়ানী পৌরসভার চকসিঙ্গা এলাকার তিনতলা বাসভবনে আগুন দেয়া হয়।
স্থানীয় গণমাধ্যমকে বাড়ির কেয়ারটেকার জসিমউদ্দিন জানান, “শতাধিক মোটরসাইকেলে বিক্ষুব্ধ লোকজন বাড়ির সামনে আসে। এরপর কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পরে বাড়িতে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা।”
৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমের জামালপুর শহরের বকুলতলা এলাকায় অবস্থিত বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছে। এরআগে ৫ আগস্ট এই বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া পর অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
বৃহস্পতিবার(৬ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টার অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে তার ঢাকার ধানমন্ডির বাসা থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এখন তিনি ডিবি হেফাজতেই রয়েছে। অন্যদিকে তার বাবা জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ আলীর জামালপুর সদর উপজেলার নরুন্দি ইউনিয়নের নরুন্দি রেলস্টেশন এলাকায় অবস্থিত বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
সর্বশেষ স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী- বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টি এলাকায় বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে স্থানীয় ছাত্র-জনতার ব্যানারে একটি দল লোক।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে অর্ধশতাধিক জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য-ম্যুরাল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা থেকে শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম নামফলক মুছে ফেলা এবং ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া বিভিন্ন জেলার আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের খবর উঠে এসেছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রংপুরে কারমাইকেল কলেজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে। এছাড়া যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ফেনী, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বরিশালসহ একাধিক জেলার শহুরের বিভিন্ন সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাঙচুরে ঘটনাও ঘটেছে।
এছাড়া ঢাকার বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালসহ সারাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে শেখ পরিবারের সদস্যদের নামফলক খুলে ফেলা এবং মুছে দেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ, ফেনী, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীসহ সারাদেশে একাধিক জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে।