ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর এবার ক্রেন ও বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকার ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি (বঙ্গবন্ধু জাদুঘর)।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় সময় রাত ৮ টার দিকে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষভকারীরা। এরপর রাত ১২ টার দিকে প্রথমে একটি ক্রেন ও এক্সকেভেটর দিয়ে বাড়িটি ভাঙা শুরু করা হয়। রাত ২ টার দিকে একটি বুলডোজার নিয়ে আসা হয়।
স্থানীয় সময় রাত আড়াইটায় সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “প্রথমে ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের ৩ তলা বিশিষ্ট বাড়িটি একটি ক্রেন ও এক্সকেভেটর দিয়ে ভাঙা শুরু হয়। পরে রাত ২ টার পরে ভাঙ্গার জন্য আরও দুইটি বুলডোজার নিয়ে আসা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “রাত আড়াইটার দিকে ছাদ ধসিয়ে দিয়ে একটি ভবন গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পাশের আরেকটি ভবনও বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা যেতে পারে বাড়িটির চিহ্ন মুছে ফেলা হচ্ছে একেবারেই।”
স্থানীয় সময় রাত ১টা ৪৫ মিনিটে ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের (বঙ্গবন্ধু জাদুঘর) বাড়ির সামনে কর্মরত ফটো সাংবাদিক সাজ্জাদ হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, “রাত ১২টার দিকে একটি ক্রেন দিয়ে ধানমন্ডির-৩২ নাম্বার বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়। বাড়িটির সামনের দিক ভাঙ্গা হয়ে গেছে। এখনও ভাঙার কাজ চলমান আছে।“
আরেক স্থানীয় সাংবাদিক রাকিবুল হাসান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু হওয়ার পর মাঝখানে জ্বালানি তেলের সমস্যার কারণে ১০-১৫ মিনিট বন্ধ ছিল। ইতিমধ্যে বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ ভাঙ্গা হয়ে গেছে। এখন ভাঙ্গা চলছে।”
রাত ২ টা ৪১ মিনিটে এই প্রতিবেদন লেখার সময় সেখানে উপস্থিত তিনজন স্থানীয় সাংবাদিক ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, কয়েক হাজার মানুষ এখনও ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে উপস্থিত রয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিসহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রেন ও বুলডোজার দিয়ে বাড়িটি ভাঙার কাজ চলমান রয়েছে।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ধানমন্ডির-৩২ নাম্বার বাড়িতে বিক্ষুব্ধ একদল লোক ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে। তবে, তারা কখন এটি করেছে তার সঠিক সময়টি আমি বলতে পারবো না।"
এর আগে সন্ধ্যার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তার ভেরিফাইড ফেসবুকের এক পোস্টে বলেন, "আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।"
ধানমন্ডির-৩২ নাম্বার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর রাত ১১ টার দিকে আরেক ফেসবুক পোস্টে হানসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের চিহ্ন বিলোপের সাথে-সাথে খুনি হাসিনাসহ গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ফেসবুক ফেইজে ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। আর এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে ”বুলডোজার মিছিলের” কর্মসূচির ডাক দেয় “২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র–জনতা”।
ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে আশপাশের দোকানিরা ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, বিকাল ৫ টার দিক থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে জড়ো হতে থাকেন। সন্ধ্যার পরে বাড়ির সামনের সড়কে অনেক লোকজন জড়ো হন। আর ৮ টার দিকে বাড়ির প্রবেশ মুখের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালটি ভেঙে ফেলে। এরপর তারা বাড়ির ভেতরে ভাঙচুর ও আগুন দেয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, রাত ৮ টার দিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতাকে বাধা দেওয়া চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা সেখান থেকে সরে যায়।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পর ধানমন্ডি ৫ এ শেখ হাসিনার পারিবারিক বাড়ি সুধাসদনে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা।
এই দুই জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বের হলে পথেই তাদের গাড়ি আটকে দেয়া হয় এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পাওয়ায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান রাত ১২টার দিকে জানান, "ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও ৫ নম্বর সড়কে দুটি বাড়িতে আগুনের খবর পেয়ে আমাদের মোহাম্মদপুর স্টেশন থেকে গাড়ি বের হয়েছিল। কিন্তু পথে উত্তেজিত জনতা গাড়িগুলো আটকে দেয়। আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পাওয়ায় আর সামনে যেতে পারিনি। পরবর্তীতে আমাদের গাড়িগুলো ফিরিয়ে আনা হয়েছে।"
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি এবং হাসিনার প্রয়াত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বাড়ি ১৯৯৬ সালে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু গত বছর ৫ অগাস্ট একদল মানুষ বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে।
এর আগে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের এই বাড়িতে “বঙ্গবন্ধু জাদুঘর” আগুন দেওয়া হয়। বুধবার দ্বিতীয়বারের মতো আবার এই বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ধানমন্ডির-৩২ নাম্বারের পাশাপাশি খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত আলোচিত ‘শেখ বাড়িতে’ ভাঙচুর চালিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। পরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এটি।
বাড়িটি বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের।
শেখ হাসিনার ভাষণঃ একটি দালান ভাঙ্গা গেলেও ইতিহাস ধ্বংস করা যাবে না
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) অডিও লিঙ্কের মাধ্যমে এক ভাষণে অভিযোগ করেন যে, গত ছয় মাসে দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস “মুছে ফেলার” চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বুধবার রাতে ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভেঙ্গে ফেলার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “একটি দালান ভাঙ্গা গেলেও ইতিহাস ধ্বংস করা যাবে না।”
গত বছর ৫ অগাস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকে হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বাস করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই তিনি ফেসবুক লাইভ সম্প্রচারে অংশগ্রহণ করেন।
“যেখান থেকে জাতীর পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল এই ঘটনার পর। তখন তারা বাড়িটি লুটপাট করেছিল, কিন্তু আগুন দিয়ে পোড়ায় নাই, ভাঙ্গে নাই,” আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা বলেন।
হাসিনা বলেন যে, মুজিব ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পর ধানমণ্ডির বাসা থেকে দেশ পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সরকারী ভবনে থাকেন নি। সেই বাড়িতে ১৯৭৫-এর ১৫ই অগাস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, হাসিনার তিন ভাই, শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং ১০-বছর বয়সী শেখ রাসেলকে হত্যা করা হয়।
“বত্রিশ নম্বরের বাড়ি আমরা ব্যক্তিগত ভাবে ব্যবহার করিনি। এটা মিউজিয়াম, সাড়া বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতারা এসেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন, সরকার প্রধান এসেছেন, ঐ বাড়ি ভিজিট করেছেন। আজকে সেই বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কেন? বাড়িটার কী অপরাধ? ঐ বাড়িটাকে কেন এত ভয়,” তিনি প্রশ্ন করেন।
বাংলাদেশের প্রায় ৫৪ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনা পাঁচ মেয়াদে মোট ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৬ সালের জুন মাসে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের পর তিনি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ২০১১ সালে বাতিল করেন।
এর পরের তিনটি নির্বাচন – ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে – ব্যাপক কারচুপি এবং জালিয়াতির কারণে বিতর্কিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের গণমাধ্যমে দুর্নীতি, বিশেষ করে অর্থ পাচারের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।