অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

 
শেখ হাসিনা ফেসবুক লাইভে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস 'মুছে ফেলার' চেষ্টা চলছে

শেখ হাসিনা ফেসবুক লাইভে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস 'মুছে ফেলার' চেষ্টা চলছে


বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। ফাইল ফটো।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। ফাইল ফটো।

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) অডিও লিঙ্কের মাধ্যমে এক ভাষণে অভিযোগ করেন যে, গত ছয় মাসে দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস “মুছে ফেলার” চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বুধবার রাতে ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভেঙ্গে ফেলার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “একটি দালান ভাঙ্গা গেলেও ইতিহাস ধ্বংস করা যাবে না।”

“লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে যে পতাকা পেয়েছি, যে সংবিধান পেয়েছি, যে স্বাধীনতা পেয়েছি, তা ঐ কয়েকজন বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবে, সেই শক্তি তাদের হয় নাই এখনো,” আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র লীগের ফেসবুক পাতায় প্রচারিত ভাষণে হাসিনা বলেন।

“তারা একটা দালান ভাঙ্গতে পারে, কিন্তু ইতিহাস তারা ধ্বংস করতে পারে না। ইতিহাস তার প্রতিশোধ নেয়, একথাও তাদের মনে রাখতে হবে,” তিনি বলেন।

গত বছর ৫ অগাস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকে হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বাস করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই তিনি ফেসবুক লাইভ সম্প্রচারে অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি এবং হাসিনার প্রয়াত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বাড়ি ১৯৯৬ সালে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু গত বছর ৫ অগাস্ট একদল মানুষ বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে।

বুধবার রাতে বুলডোজার এবং এক্সক্যাভেটর দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভেঙ্গে ফেলা হয়। ফটোঃ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।
বুধবার রাতে বুলডোজার এবং এক্সক্যাভেটর দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভেঙ্গে ফেলা হয়। ফটোঃ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।

হাসিনার ফেসবুক ভাষণের ঘোষণা দেয়ার পর ঢাকায় ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে অভিযান চলানোর আহ্বান জানায়। বুধবার গভীর রাতে বুলডোজার নিয়ে এসে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের স্মৃতি-জড়িত ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।

“যেখান থেকে জাতীর পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল এই ঘটনার পর। তখন তারা বাড়িটি লুটপাট করেছিল, কিন্তু আগুন দিয়ে পোড়ায় নাই, ভাঙ্গে নাই,” আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা বলেন।

হাসিনা বলেন যে, মুজিব ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পর ধানমণ্ডির বাসা থেকে দেশ পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সরকারী ভবনে থাকনে নি। সেই বাড়িতে ১৯৭৫-এর ১৫ই অগাস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, হাসিনার তিন ভাই, শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং ১০-বছর বয়সী শেখ রাসেলকে হত্যা করা হয়।

“বত্রিশ নম্বরের বাড়ি আমরা ব্যক্তিগত ভাবে ব্যবহার করিনি। এটা মিউজিয়াম, সাড়া বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতারা এসেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন, সরকার প্রধান এসেছেন, ঐ বাড়ি ভিজিট করেছেন। আজকে সেই বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কেন? বাড়িটার কী অপরাধ? ঐ বাড়িটাকে কেন এত ভয়,” তিনি প্রশ্ন করেন।

বাংলাদেশের প্রায় ৫৪ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনা পাঁচ মেয়াদে মোট ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৬ সালের জুন মাসে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয়ের পর তিনি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ২০১১ সালে বাতিল করেন।

এর পরের তিনটি নির্বাচন – ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে – ব্যাপক কারচুপি এবং জালিয়াতির কারণে বিতর্কিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের গণমাধ্যমে দুর্নীতি, বিশেষ করে অর্থ পাচারের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

'জঙ্গি সন্ত্রাসীদের দেশ'

হাসিনা তাঁর ভাষণের দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর শাসনামলে অর্থনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন। তবে তিনি দুর্নীতি সম্পর্কে বা নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। গত বছর ছাত্রদের আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ব্যাপক প্রাণহানির জন্য তিনি, কোন প্রমাণ ছাড়াই, “ষড়যন্ত্রকারীদের” দায়ী করেন।

হাসিনা বলেন যে, ২০১৮ সালে সরকারী চাকুরীতে কোটার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনের পর তিনি কোটা বাতিল করেন। পরবর্তীতে কিছু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের করা মামলায় হাই কোর্ট কোটা পুনর্বহাল করলেও, সরকার আপিলের মাধ্যমে তা স্থগিত করে। তিনি দাবী করেন, কোটা কোন ইস্যুই ছিলনা, যদিও ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্রদের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল কোটা বাতিল।

“কিন্তু এটা যে কোটা আন্দোলন ছিল না, এটা যে ভিন্ন একটা ষড়যন্ত্র, সেটা আমি বারবার বলেছি। এটা ছিল সেই একজন ক্ষমতালোভীর মেটিকিউলাস ডিজাইনের অংশ,” তিনি বলেন। “যে অংশ হিসেবে সে ছাত্র হত্যা করেছে, জনগণকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে, পুলিশ হত্যা, সাংবাদিক হত্যা, সাংস্কৃতিক কর্মী হত্যা, সাড়া দেশ ক্ষত বিক্ষত করা, অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়েছে।”

তিনি দাবী করেন গত বছর অগাস্ট মাস থেকে দেশের মানুষের “অধিকার কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছে” এবং বাংলাদেশকে “সন্ত্রাসীদের দেশে” রূপান্তরিত করা হয়েছে।

“বাংলাদেশকে নিয়ে যেন একটা ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছে। যে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল ছিল, উন্নয়নের বিস্ময় ছিল, সেই বাংলাদেশ চরমভাবে ধ্বংস করে আজ একটি জঙ্গি সন্ত্রাসীদের দেশে পরিণত করা হয়েছে।”

ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বেশ কয়েকবার অডিও লিঙ্কের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তব্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের গণমাধ্যম তাঁর ভাষণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এই প্রচার আটকাতে গত বছর ৫ ডিসেম্বর হস্তক্ষেপ করে আদালত। হাসিনার বক্তব্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করার উপর ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা থাকায়, তাঁর বক্তব্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বুধবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন যে, হাসিনার কোনো ভাষণ যদি এখন কোনো গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তাহলে সে গণমাধ্যম "শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করছে বলে ধরে নিতে হবে।" তিনি বলেন তারা "হাসিনা চ্যাপ্টার ক্লোজ" করে দিয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, আদালতের আদেশ নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত নন। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, সরকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা বন্ধ করতে পারলেও, তারা "সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমকে বন্ধ করতে পারবে না।"

“বাংলাদেশের মানুষের সচেতনতা যে স্তরে আছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে, তার খোঁজ খবর রাখেন,” তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন। “বাংলাদেশর মানুষই বিকল্প পথ ও জায়গাগুলো বেছে নেবেন।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গত ৫ ডিসেম্বর হাসিনার “ঘৃণাসূচক” বক্তব্য নিষিদ্ধ করার আদেশ দেয়। হাসিনার যেসব বক্তব্য ইতোমধ্যে ইলেক্ট্রনিক এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো সরিয়ে ফেলার আদেশও দেয় আদালত।

XS
SM
MD
LG