অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

আফগান নারীদের লক্ষ্য করে তালিবানের নির্দেশ: বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ


কাবুলের ওয়াজির আকবর খান হাসপাতালে একজন নারী নার্স একজন রোগির শুশ্রুষা করছেন। ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১।
কাবুলের ওয়াজির আকবর খান হাসপাতালে একজন নারী নার্স একজন রোগির শুশ্রুষা করছেন। ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১।

জাতিসংঘ বুধবার আফগানিস্তানের উগ্রবাদী তালিবান নেতাদের তাদের সাম্প্রতিক নির্দেশ আরোপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে ওই সংকাটাপন্ন রাষ্ট্রে ওই নির্দেশে নারীদের জন্য চিকিৎসা বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের এই আহ্বান ছাড়াও, তালিবানকে এই নির্দেশ প্রত্যাহার করার জন্য সম্মিলিত ভাবে অনেকেই আহ্বান জানাচ্ছেন। সমালোচকরা বলছেন ওই নির্দেশের ফলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের অবশিষ্ট সুযোগ থেকে কার্যত আফগান নারী ও মেয়েদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহযোগিতা মিশন( ইউএনএএমএ) এক বিবৃতিতে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, “খবরে প্রকাশিত নির্দেশটি যদি প্রয়োগ করা হয়, তা হলে তা হবে নারী ও মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ ও স্বাস্থ্য পরিচর্যার অধিকরের উপর আরো বিধিনিষেধ আরোপ।

এতে আরও বলা হয়, ইউএনএএমএ এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবরে “ প্রচন্ড ভাবে উদ্বিগ্ন” এবং তারা সরকারি তালিবান চ্যানেলগুলির মাধ্যমে তা যাচাই করে দেখছে তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিশ্চিত করার সংবাদ তারা এখনও পায়নি।

প্রায় আড়ালে থাকা তালিবান নেতা হিবাতুল্লাহ আখুনজাদার জারি করা এই নির্দেশ মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হয়েছে। এর একদিন আগেই কাবুলে এক বৈঠকে মেডিকাল স্কুলগুলির প্রধানদের এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয় বলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এবং ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। তবে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে তাদের কোন আলোচনা করা নিষিদ্ধ বলে তারা নাম প্রকাশ না করেই কথা বলেছেন।

ফাইল- আফগান মেয়েরা কাবুলে একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে শিক্ষার অধিকার চেয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানো সেখানে নিষিদ্ধ। আফগানিস্তান, আগস্ট ২, ২০২২।
ফাইল- আফগান মেয়েরা কাবুলে একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে শিক্ষার অধিকার চেয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানো সেখানে নিষিদ্ধ। আফগানিস্তান, আগস্ট ২, ২০২২।

সেখানকার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিবান কর্মকর্তারা এই নির্দেশনার খবর কিংবা সোমবার আফগান রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে এখনও কোন মন্তব্য করেননি।

জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে যে এই নির্দেশ আফগান স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং দক্ষিণ এশিয়ার ওই দরিদ্র দেশের উপর “ক্ষতিকর প্রভাব” ফেলতে পারে।

সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, “ ইউএনএএমএ বর্তমান কর্তৃপক্ষকে বলছে গোটা দেশ জুড়ে আফগান নারী ও মেয়েদের জীবনে এই নির্দেশের যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি আরোপের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হোক”।

স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম জানায় যে ৩০,০০০ ‘এর ও বেশি নারী ও মেয়ে গোটা দেশ জুড়ে আফগান মেডিকাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হয়েছিল এবং অনেকেই এই মঙ্গলবার তাদের পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল যখন আকস্মিক ভাবে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। যে সব নারী ধাত্রী এবং নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তাদেরকে ক্লাসে ফিরে আসতে নিষেধ করা হয়।

মানবাধিকার কর্মীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে, ধাত্রী ও নারী নার্সসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে লক্ষ লক্ষ নারী বঞ্চিত হবেন এই পুরুষ আধিপত্যে শাসিত আফগান সমাজে যেখানে তালিবান বহু প্রদেশেই পুরুষ চিকিৎসকদের নারীর চিকিৎসা করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

হিউমান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে সতর্ক করেছে যে বিতর্কিত এই নির্দেশের কারণে নতুন নারী চিকিৎসাকর্মীর প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিলে, “ এর ফল হবে নারীদের জন্য অহেতুক কষ্ট, দুঃখ,অসুস্থতা এবং মৃত্যু কারণ তাদের চিকিৎসার জন্য কোন নারী চিকিৎসা কর্মী থাকবেন না”।

একজন পদস্থ আফগান কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে দ্য এসোসিয়েটেড প্রেস হুশিয়ার করে দিয়েছে যে এই নিষেধাজ্ঞা যদি স্থায়ী হয়, তা হ’লে দেশটি এত বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে যা তালিবান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, “নারীদের স্টাফ হিসেবে প্রশিক্ষণ না দিলে, দূর্গম এলাকাগুলিতে নারী ও শিশুদের মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে”।

ফাইল- একজন নার্স( ডানে) লাশকার গাহ’র কাছে ইয়ামুহাম্মদ গ্রামের একজন স্থানীয় মুরুব্বির বাড়িতে বসে মোবাইল ক্লিনিকে রোগিকে নিবন্ধিত করছেন। হেলমান্দ প্রদেশ, মার্চ ২৮,২০২১।
ফাইল- একজন নার্স( ডানে) লাশকার গাহ’র কাছে ইয়ামুহাম্মদ গ্রামের একজন স্থানীয় মুরুব্বির বাড়িতে বসে মোবাইল ক্লিনিকে রোগিকে নিবন্ধিত করছেন। হেলমান্দ প্রদেশ, মার্চ ২৮,২০২১।

এই নিষেধাজ্ঞা আদেশের খবর এবং এর ফলে মানবিক সংকট বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনায় জনগণের দূর্দশা সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, “ কঠিন উদ্বেগ” প্রকাশ করেছে ।

বুধবার এক বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, “ এই সিদ্ধান্ত হচ্ছে আরেকবার বিস্ময়কর ভাবে মৌলিক মানবাধিকার লংঘন এবং আফগানিস্তানে নারীর শিক্ষালাভের ওপর অযৌক্তক আক্রমণ।

বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলে, “ আমরা তালিবানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই বৈষম্যমূলক নীতি পাল্টানোর এবং সকল আফগানের জন্য শিক্ষা ও মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযোগ সহ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা”।

আফগান জাতীয় ক্রিকেট টিমের ক্যাপটেন রশিদ খান এই সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার জন্য আফগান নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এক্স এ বলেন, “ গভীর দুঃখ ও নিরাশার সঙ্গে আমি আফগানিস্তানে আমার মা বোনদের জন্য সম্প্রতি শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি দেখছি।

খান লেখেন, “ দেশটি সর্বক্ষেত্রে , বিশেষত চিকিৎসা ক্ষেত্রে পেশাজীবির প্রয়োজন অনুভব করছে। নারী চিকিৎসক ও নার্সদের মারাত্মক ঘাটতি বিশেষ করে উদ্বেগের কারণ, স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও নারীদের মর্যাদার উপর এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে”।

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এবং ত্রাণ গোষ্ঠীগুলি বলছে হিবাতুল্লাহর জারি করা কয়েক ডজন নির্দেশ সেই দেশে নারীদের কাজের ও শিক্ষার নাগাল থেকে কঠিন ভাবে বঞ্চিত করছে যে দেশটি বহু বছরের যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও অন্যতম মারাত্মক এক মানবিক সংকটের সম্মুখীন।

কাবুলের বর্তমান এই সরকার যাকে কোন দেশই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় না তাদের নীতিকে এই বলে যথার্থতা দেয় যে তা শারিয়া বলে পরিচিত ইসলামি আইনের সঙ্গে সামঞ্জন্যপূর্ণ । তারা তাদের সরকারের সমালোচনাকে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে নাকচ করে দিয়েছে।

XS
SM
MD
LG