গাজা ভূখন্ড ও লেবাননে সংঘাত বন্ধের সর্বসাম্প্রতিক প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বৃহস্পতিবার বলেন যে আলোচকরা “ আগামি দিনগুলিতে” মিলিত হবেন। তিনি ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোকজনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আরও সহায়তা হিসেবে ১৩ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার প্রদানের ঘোষণা করেন।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরাহমান আল সানির সঙ্গে দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লিংকেন বলেন, “ আলোচকদের আবার একত্রিত হবার প্রসঙ্গটি আসলে বিশেষত পণবন্দিদের ফেরত আসা এবং গাজায় অস্ত্রবিরতি , এ দুটি বিষয়ের উপর তাদের কাজ নিবদ্দ থাকবে। আর এ ছাড়া যে কাজ আমরা গুরুত্বের সঙ্গে করছি তা হলো লেবানন সম্পর্কে যাতে এ ব্যাপারে একটি কুটনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো যায়”।
যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক সহপক্ষদের সঙ্গে একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছে যাতে ইসরায়েল গাজা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে , নিশ্চিত করা যায় যে হামাস আবার নিজেকে সংগঠিত করতে না পারে এবং গাজার সুরক্ষা ও পূণনির্মানের ফিলিস্তিদের সহায়তা প্রদান করা যায়।
আরও মানবিক সহায়তা
ব্লিংকেন বলেন “ আজ আমরা পশ্চিম তীরের গাজায় এবং ওই অঞ্চলের ফিলিস্তিনিদের পানি, পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য আরও ১৩ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের মানবিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিচ্ছি।
তিনি গাজায় মানবিক সংকট মোকাবিলার গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে সেখানকার জনগণ যে প্রতিদিন অস্বাভাবিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন সেই কথাটি তুলে ধরেন। ব্লিংকেন বলেন, “ সেটা আরও বেশি জরুরি কারণ শীত আসছে”।
এই অর্থ ঘোষণার মাধ্যমে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মানবিক সহায়তা বাবদ যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অর্থের পরিমাণ ১২০ কোটি ডলার ।
এরই মধ্যে ইসরায়েল ও লেবাননের হেজবুল্লাহর মধ্যকার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ফ্রান্স বৃহস্পতিবার প্যারেস একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে।
ফ্রান্স লেবাননে ১০ কোটি ৮০ লক্ষ ও জার্মানি ১০ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতির কথা ঘোষণা করে।
অস্ত্রবিরতি আলোচনা
এটা এখনও পরিস্কার নয় যে হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর পর আসন্ন অস্ত্রবিরতি আলোচনায় সম্পৃক্ত হতে হামাস প্রস্তুত কী না।
আল সানি সংবাদদাতাদের বলেন, “ আলোচনায় উঠে আসবে এমন যে কোন উদ্যোগের বিষয়ে আমরা মিশরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সমন্বয় সাধন করছি। আজ মিশর ও হামাসের মধ্যে আলোচনা চলছে। আমরা আশা করছি এই সব আলোচনা থেকে ইতিবাচক কিছু বেরিয়ে আসবে। আর তার পর যে আলোচনা হবে, তা হবে এরই ফলাফল বিষয়ক”।
আল সানি আরও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনাকারীরা এই অচলাবস্থা দূর করার প্রচেষ্টায় খুব শিগগিরই দোহায় তাদের সহপক্ষদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
এ সপ্তাহে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনার পর ব্লিংকেন বৃহস্পতিবার আল সানির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি শুক্রবার লন্ডনে আরব কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হবেন।
এ সপ্তাহে আরও আগের দিকে, জাতিসংঘের বানিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের একটি প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের অর্থনৈতিক প্রভাবের একটি করুন চিত্র ফুটে উঠেছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে যুদ্ধ যদি আগামিকালও বন্ধ হয়ে যায় এবং গাজা যদি তার সংঘাতপূর্ব অবস্থায় ফিরে যায় , তা হলেও গাজাকে তার যুদ্দের আগেকার ভঙ্গুর অর্থনীতির পর্যায়ে ফিরে যেতে ৩৫০ বছর সময় লেগে যেতে পারে।
জেনারেলদের পরিকল্পনা
বৃহস্পতিবার ব্লিংকেন যুদ্ধপরবর্তী গাজায় ইসরায়েলের পুনর্দখলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নতুন করে তুলে ধরেন এবং “ সম্পূর্ণ ও মৌলিক” ভাবে জেনারেলদের পরিকল্পনা নাকচ করে দেন। এটি ছিল ইসরায়েলের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের প্রস্তাব যাতে তাদের কথায় হামাস সন্ত্রাসীদের অভুক্ত রাখার লক্ষ্যে গাজার উত্তরাঞ্চলে মানবিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ রাখা হোক।
ব্লিংকেন আরও বলেন, তাদের মধ্যকার বৈঠকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে এটা ইসরায়েলি সরকারের নীতি নয়। ব্লিংকেন সংবাদদাতাদের বলেন, “ ইসরায়েল সরকার বলছে যে এটি ইসরায়েলের নীতি নয়”।
প্যারিস সহায়তা সম্মেলনে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস এক ভিডিও বার্তায় অবিলম্বে অস্ত্র বিরতির এবং নিরাপত্তা পরিষদের ১৫৫৯ ও ১৭০১ প্রস্তাবসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। এই প্রস্তাবগুলিতে চিরকালের জন্য হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং লেবানন থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
গুতেরেস বলেন যে লেবাননে ১২ লক্ষ লোক বাস্তুচ্যূত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
তিনি বলেন, “ আমি লেবাননের নেতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে সে দেশের জরুরি রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলার জন্য তারা যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণ কার্যক্ষম করার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন”।
যুদ্ধক্ষেত্র
বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায় যে তারা বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলের শহরতলীগুলিতে হেজবুল্লাহর অস্ত্র উৎপাদনের স্থানে নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে।
লেবাননের সামরিক বাহিনী বলেছে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইয়াতের গ্রামের কাছে তাদের তিনজন সৈন্য উদ্ধার অভিযান চালানোর সময়ে ইসরায়েলি আক্রমণে নিহত হয়।
ইসরায়েল বলেছে যে তাদের লড়াই লেবাননের বিরুদ্ধে নয়, ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে । এই সংঘাত আঞ্চলিক সংঘর্ষের আশংকা বাড়িয়ে তুলেছে।
গাজার চিকিৎসা-কর্মীরা বলেন ইসরাইলের আক্রমণে একটি স্কুলের আঘাত হানে যা কীনা নুসেইরাতে একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল আর এই আক্রমণে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হন।
বৃহস্পতিবার আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বলেছে দামেস্কে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত একজন সৈন্য নিহত এবং আরও সাতজন আহত হয়েছে।
সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে আক্রমণ সম্পর্কে ইসরায়েল খুব কমই মন্তব্য করে তবে ইরানের পক্ষ নিয়ে কাজ করা প্রতিহত করতে এবং হেজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র হস্তান্তর বন্ধ করার অভিযান হিসেবে ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে সম্পৃক্ত লক্ষ্যবস্তুগুলির উপর আঘাত হেনেছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের সন্ত্রাসী আক্রমণে জঙ্গিরা প্রায় ১২০০ লোককে হত্যা করে এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। হামাস এখনও প্রায় ১০০ জনকে জিম্মি করে রেখেছে , মনে করা হচ্ছে এদের এক-তৃতয়াংশই মারা গেছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণে ৪২,৮৪৭ ‘এর বেশি ফিলিস্তিনি নহত হন তবে ইসরায়েল বলছে যে নিহতদের এই সংখ্যার মধ্যে কয়েক হাজার হামাস জঙ্গিও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও অন্যান্যরা হেজবুল্লাহ এবং হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছে।
এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন ভিওএ’র কেন ব্রেডমেয়ার, ক্রিস হানাস ও জাতিসংঘের সংবাদদাতা মার্গারেট বশির। এই প্রতিবেদনের জন্য কিছু তথ্য পাওয়া গেছে এপি, এএফপিও রয়টার্স থেকে।