মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে যে চীন থেকে কেনা ছ’টি এফটিসি-২০০০জি ফাইটার জেটগুলি সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে এবং পর্যবেক্ষকরা উদ্বিগ্ন বোধ করছেন যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য চীনের সামরিক সাহায্য সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করছে এবং অসামরিক লোকজনের ভোগান্তিকে আরো তীব্র করে তুলছে।
চীনের এফটিসি-২০০০জি’র মতো জঙ্গি জেট সরবরাহ , মিয়ানমারের জান্তাকে আকাশে প্রাধান্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছে এবং এর ফলে মিয়ানমার জুড়ে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
মিডিয়ার খবর অনুযায়ী ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের এই চালানটি হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য এফটিসি-২০০০জি’ র দ্বিতীয় চালান । প্রথমটি এসেছিল ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে।
সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া পরে ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে এফটিসি-২০০০জি’ বিমানগুলি দেখায়। অনুমান করা হচ্ছে এ বছরের ডিসেম্বর মাসে বিমান বাহিনী দিবসে এই বিমান বহরের দ্বিতীয় অংশ প্রদর্শন করা হবে।
থাই-মিয়ানমারের সীমান্তের একটি গোপন স্থান থেকে মিয়ানমার বিমান বাহিনীর একজন সাবেক সার্জেন্ট জায় ইয়া ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ রাশিয়ার তৈরি ইয়াক-১৩০ বিমানগুলির অনেকটাই এখন অকেজো হয়ে পড়েছে, তাই সামরিক তৎপরতার জন্য এখন চীনা জেটগুলো অপরিহার্য”। তিনি আরও বলেন চীনা জেটগুলো প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তার অনেকগুলোই এখন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে রাখা হয়েছে।
জায় ইয়া প্রায় এক দশক ধরে মিয়ানমারের বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন । ২০২১ সালে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন।
মিয়ানমার বিমান বাহিনীতে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে জায় ইয়া বলেন যে রুশ বিমানগুলির মূল্য বেশি এবং জ্বালানি তেলের খরচও বেশি, অন্যদিকে চীনা বিমানগুলি মিয়ানমারের বর্তমান প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে অধিকতর মানানসই। তিনি বলেন, “এফটিসি-২০০০জি আসবার আগেই রাশিয়ার তৈরি ৪ টি সুখোই-সু-৩০ বিমান আসে তবে এফটিসি-২০০০জি তাৎক্ষণিক ভাবেই ব্যবহার করা যায়”।
ভয়েস অফ আমেরিকার বর্মী বিভাগ নে পি তাউয়ে মিয়ানমার সরকারের সামরিক তথ্য টিম এবং ইয়াঙ্গুন ও ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাসের সঙ্গে এফটিসি-২০০০জি সরবরাহের বিষয়ে যোগাযোগ করে কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাতে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এফটিসি-২০০০জি’র ব্যবহার
ক্ষেপণাস্ত্র , রকেট ও বোমা বহনে এফটিসি-২০০০জি’র ক্ষমতা জান্তার বিমান আক্রমণের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষত শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে এবং ব্রাদারহুড অ্যালায়ান্স নিয়ন্ত্রিত সংঘাতপূর্ণ এলাকায়। পর্যবেক্ষকদের মতে এই ব্রাদারহুড অ্যালায়ন্স হচ্ছে চীনা সীমান্তের কাছে জাতিগোষ্ঠীগত একটি সশস্ত্র দল।
জাস্টিস ফর মিয়ানমার এবং ইনফো বারম্যানির একটি প্রতিবেদনে চীনের দেওয়া এফটিসি-২০০০জি’ বিমানগুলো কি ভাবে অসামরিক এলাকাগুলিতে বিমান হামলা চালাতে ব্যবহার করা হয়েছে তার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে নামপাথকার এলাকায় বিরোধী বাহিনী একটি এফটিসি-২০০০জি বিমান ভূপতিত করে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি এফটিসি-২০০০জি বিমান নামখামের কাছে আবাসিক ভবনগুলির উপরে বোমাবর্ষণ করে।
‘ এতে ভারসাম্যে কোন পরিবর্তন আসবে না’
লাওয়ি ইনস্টিটিউটের দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল রহমান ইয়াকব জেট বিমান সরবরাহের ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ চীন এই গৃহযুদ্ধে একটি পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে জান্তাকে অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করে মিয়ানমারের এই সংকটে চীন নিরপেক্ষ নয়”।
যদিও জঙ্গি বিমান সরবরাহ জান্তাকে কিছুটা কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে , ইয়াকব বলেন , “ সামগ্রিক ভাবে এতে জান্তার পক্ষে ভারসাম্যটা আসবে না। জান্তা এখন আসলে বিদ্রোহ দমনের বিপক্ষ পরিস্থিতির সম্মুখীন। বিদ্রোহ তৎপরতা কেবল মাত্র বিমান দিয়ে দমন করা যাবে না। এর জন্য স্থল বাহিনীরও প্রয়োজন পড়বে। আর ঠিক এখানেই তারা বড় রকমের সমস্যায় পড়েছে- তাদের জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে”।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে চীনের কর্মতৎরতা সামরিক সমর্থন প্রদানের চেয়েও বেশি।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অফ পিস, কিংবা ইউএসআইপি ‘র বার্মা কর্মসূচির কান্ট্রি ডিরেক্টার জেসন টাওয়ার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ এটা খুবই পরিস্কার যে চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে এখনও মিয়ানমার সরকার বলে মনে করে এবং এমনটি মনে হয় না যে খুব শিগগিরই চীনের অবস্থান বদলাবে”।
তাঁর যুক্তি হলো জঙ্গি বিমান বিক্রি করা মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীনের ইচ্ছারই ইঙ্গিত বহন করে এবং তারা সামরিক জান্তাকে মেনে নিতে আন্তর্জাতিক সমাজকেও রাজি করাতে চায়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ঊর্ধ্বতন পরামর্শক টমাস কীন বলেন চীনের লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা আনা এবং তার কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত করা। ইতিন বলেন, “ আমার মনে হয় চীন চায় স্থিতিশীলতা এবং কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা। চীন সামরিক বাহিনী ও জাতিগোষ্ঠীগত সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের উপর জোর দিচ্ছে”।
অসামরিক লোকদের প্রতিক্রিয়া,আন্তর্জাতিক আহ্বান
এই সংঘাতে লক্ষ লক্ষ লোক বাস্তুচ্যূত হয়েছেন, জাতিসংঘের হিসেব মতে অভূত্থানের পর থেকে ২৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন । জাতিসংঘ বলছে বোমা বর্ষণের শিকার হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকাগুলি, বেপরোয়া ভাবে এই আক্রমণে বেসামরিক লোকজনের জীবনের প্রতি তারা কোন তোয়াক্কাই করেনি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নৃশংসতার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতি নিন্দা জানিয়েছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের প্রধান নিকলাস কুমিজান জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে এক বিবৃতিতে বলেন, “ অনেক ক্ষেত্রে অসামরিক লোকজন শুধু ঘটনাচক্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, তাঁরা আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছেন যাতে মনে হচ্ছে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে তা করা হচ্ছে”।
অ্যামনেস্টি ইন্টান্যাশনাল ও জাস্টিস ফর মিয়ানমারসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলি জান্তাকে অস্ত্র দেয়া বন্ধ করতে চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।