ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে তৈরি ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’ ভেঙে ফেলার পর তা নতুন করে নির্মান করার কথা আপাতত ভাবছে না পুলিশ।
গুলশান বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার রিয়াজুল হক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমরা এখন আসলে নতুন করে ভাস্কর্য তৈরি নিয়ে চিন্তা করছি না। আপনার জানেন, আমাদের অনেকগুলো থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ভাড়া করা গাড়িতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ফলে, আগে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করাই এখন অগ্রাধিকার।"
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা- গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার দিনই এই ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। তবে, কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা তারা জানেন না।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা ইতালির নয়জন, জাপানের সাতজন, ভারতের একজন, বাংলাদেশের দুইজন এবং বাংলাদেশি-আমেরিকান একজন নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। আর এই হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হয় দুই পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন।
ঘটনার দিন রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী হামলাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের 'সৈনিক' বলে দাবি করে এবং হামলার দায় স্বীকার করে ২০জন নিহত হবার কথা জানায়।
নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে গুলশান থানার সামনে ভাস্কর মৃণাল হক তৈরি করেন 'দীপ্ত শপথ' নামের ভাস্কর্যটি। জঙ্গি হামলার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১ জুলাই এই ভাস্কর্য উদ্বোধন করেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
বর্তমান ভাটারা থানার (পুরাতন গুলশান থানা) সামনে গেলে দেখা যায়, ‘দীপ্ত শপথ’ ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্টিলের খুঁটিতে শিকল দিয়ে ঘেরাও ভাস্কর্যের জায়গাটি এখন খালি পড়ে আছে।
দেখা গেছে, ভাস্কর্যের ভাঙা অংশের বেশ কয়েকটি লোহার রড সেখানে বের হয়ে আছে।
তার পাশে থাকা 'দীপ্ত শপথে'র নামফলক লেখাগুলোও অনেকাংশে মুছে গেছে। মুছে যাওয়া নামফলকে লেখা রয়েছে- হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা প্রতিরোধে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্য স্মরণে ‘দীপ্ত শপথ’।
ভাঙা ভাস্কর্যের সামনে উপস্থিত পুলিশের কয়েকজন সদস্য প্রতিবেদককে বলেন, "৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন অর্থাৎ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিজয়য়ের দিনে ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এরপরও বেশকিছু দিন সেখানে ভাস্কর্যের ভাঙা অংশগুলো পড়ে ছিল।"
তারা বলেন, "ভাস্কর্যের পেছনে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কয়েকটি পোস্টার লাগানো ছিল। পরে এখানে ভাটারা থানার কার্যক্রম শুরু হলে জায়গাটি পরিষ্কার করা হয় এবং হিযবুত তাহরীরের পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।"
তৎকালীন সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯–এর অধীনে হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৫ সেপ্টেম্বর আবেদন করা হয়েছে বলে ৯ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও পাকিস্তানে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তৌহিদ আহম্মেদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “৫ আগস্ট 'বিজয়ের সময়' ‘দীপ্ত শপথ’ ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই সময় যে রকম পরিস্থিতি ছিলো তাতে, কোনো ধরণের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল না।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আমাদের উধ্বর্তন স্যারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবো, যদি নির্দেশনা আসে তাহলে সেই অনুযায়ী আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
“অন্যান্য আইনশৃঙ্খলার বিষয়গুলো নিয়েও এখন আমরা ঠিক মতো কাজ করতে পারছি না। আমাদের লোকজনের যে মনোবল ভেঙে গেছে, সেটা এখনও ফেরানো সম্ভব হয়নি। যার ফলে, আমরা মূলত সেইগুলো নিয়ে এখন কাজ করছি” বলে উল্লেখ করেন তৌহিদ আহম্মেদ।
ব্যথিত পরিবারের সদস্যরা
নিহত এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনায় ব্যথিত তাদের পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে ভাঙা ভাস্কর্য-এর পেছনে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগানোর ঘটনায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত পরিবারের সদস্যরা।
তবে, পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, যারা এই ভাস্কর্যটি ভেঙেছে তারা না বুঝে পুলিশ-প্রশাসনের ওপর ক্ষোভ থেকে এটি করছে। কারণ, তারা মনে করেন, এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা 'মানবতা ও দায়িত্ববোধ' থেকে সেদিন নিজেদের 'জীবন উৎসর্গ' করেছিলেন।
নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের ছোট ভাই সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “পরিবারের সদস্য হিসেবে ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাটি আমাদের জন্য কষ্টের। এই ঘটনায় আমরা ব্যথিত ও স্তম্ভিত।”
তিনি আরও বলেন, “আসলে যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের পরে বিক্ষিপ্তভাবে নানা ঘটনা ঘটে। অনেক সময় মানুষ বোঝে, না বুঝে অনেক কাজ করে ফেলে। যে রকম ৫ আগস্ট সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ, ম্যুরাল ভাঙচুর হয়েছে। সেই রকমভাবে হয়তো এই ভাস্কর্যটি ভাঙা হয়েছে।”
“নিহত দুই পুলিশ সদস্য তো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য কাজ করেন নাই। হোলি আর্টিজানের ভেতরে মানুষ আছে, তারা সাহায্য চাচ্ছে। সেই মানুষদের সহায়তা ও উদ্ধার করতে তারা গিয়ে শহীদ হয়েছে” বলে যোগ করেন শামসুজ্জামান।
নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনো শঙ্কা নেই বলে জানান শামস।
তিনি বলেন, “অবশ্যই আমরা নিরাপদ আছি। তারপরও বলবো যে, একটু শঙ্কা থেকেই যায়। কারা ভেঙেছে, সেটা তো জানি না। হয়তো কারও ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে, ভাঙা ম্যুরালের পাশে একটা সংগঠনের পোস্টার লাগানো ছিল। এটা নিয়ে পরিবারের সদস্যরা চিন্তিত।”
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, ৫ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ধ্বংস করা হয়েছে। এসব ভাস্কর্য ও ম্যুরালের মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক। ধ্বংস করা হয়েছে ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাসের মূর্তি, সুপ্রিম কোর্টের থেমিস ও শিশু একাডেমির দুরন্ত ভাস্কর্যটিও।
ওই কয়েক দিনে শুধু ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ১৫টি স্থানে ১২২টির বেশি ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও রিলিফ ভাস্কর্য ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও উপড়ে ফেলা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক শিল্পী লালারুখ সেলিম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ভাস্কর্য ভাঙা কোনভাবেই ভালো কাজ হয়নি। এগুলোকে অবশ্যই সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল।”
এই শিল্পী বলেন, “আসলে ভাস্কর্য কেন ভাঙা হলো সেটাই বুঝলাম না। ভাস্কর্য তো থাকতেই পারতো। এটা তো কারো ক্ষতি করছে না। এগুলো তো আমাদের স্বাধীনতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো করা মোটেও ঠিক হয়নি।”