বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক ভাষণে গাজার চলমান ঘটনাকে “গণহত্যা” বলে বর্ণনা করে সেখানে অনতিবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
“সারা বিশ্বের উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না,” ড. ইউনূস শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে বলেন।
“ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংসতা, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সাথে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে,” ড. ইউনূস বলেন।
ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান এবং এর ফলে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের সুযোগের উপর আলোকপাত করেন। তিনি অভ্যুত্থানে তরুণদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন যে বর্তমান প্রজন্ম ১৯৭১ সালের মূল্যবোধ পুনরায় তুলে ধরছে।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন পুনরায় ব্যক্ত করেন। দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের অর্থ হল একটি ইসরায়েলি এবং একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান।
ড. ইউনূস বলেন এই সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে, এবং তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন যে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি শুধু আরব বা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক না, বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগজনক। “ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতা বিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়বদ্ধ করতে হবে,” তিনি বলেন।
গাজার ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১,২০০ লোক হত্যা এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে গেলে বর্তমান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। পাল্টা ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৪২,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন সেখানে “অনেক বেশি মানুষ” ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। তিনি বলেন এই যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্ব পড়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য “গভীর অর্থনৈতিক পরিণতি” নিয়ে এসেছে।
“আমরা তাই উভয়পক্ষকেই সংলাপে বসে বিরোধ নিরসনের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানাচ্ছি,” তিনি বলেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা যাতে নিজ দেশে সসম্মানে ফিরে যেতে পারে, তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহয়াতা কামনা করেন। তিনি বলেন মিয়ানমারের ভেতরে চলমান গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্যও নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করছে।
“মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বলপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখা এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত চাই,” ড. ইউনূস বলেন।
রোহিঙ্গারা যাতে সম্মানের সাথে একটি মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে, তার জন্য জাতিসংঘের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি দিয়ে ড. ইউনূস বলেন যে, এর জন্য রোহিঙ্গাদের তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি রাখাইনে নিরাপত্তা এবং অধিকারসহ ফেরা প্রয়োজন।
“রোহিঙ্গারা যাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে নিজ ভূমি – রাখাইনে – ফিরে যেতে পারে, তার পথ সুগম করা দরকার,” ড. ইউনূস বলেন।
“মিয়ানমারে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অবস্থা বিবেচনায় রেখে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে একযোগে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে মর্যাদা ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে কাজ করতে প্রস্তুত,” তিনি বলেন।
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির প্রচণ্ড লড়াই চলছে, যার ফলে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
গণঅভ্যুত্থান থেকে রাষ্ট্রীয় রূপান্তর
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণের শুরুতে বলেন দেশের সাম্প্রতিক যুগান্তকারী গণঅভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশ এখন তার নানা প্রতিষ্ঠান পুনর্বিন্যাস করার সুযোগ পেয়েছে।
“আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে,” তিনি বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণে তিনি জাতিসংঘের এই অধিবেশনে – যাকে তিনি ‘বিভিন্ন জাতির সংসদ’ বলে বর্ণনা করেন – ভাষণ দিচ্ছেন।
“আমাদের ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে,” ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন বর্তমান প্রজন্ম ১৯৭১ এবং ১৯৫২ সালের মূল্যবোধ নতুন করে তুলে ধরছে। তিনি বলেন ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে “আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পর আমাদের ‘জেনেরেশন জি’ নতুন ভাবে দেখতে শিখিয়েছে।”
“উদারতা, বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার উপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়,” বলেন ড. ইউনূস।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার একটি করুন চিত্র তুলে ধরে বলেন যে দেশের জনগণ এবং তরুণরা একসাথে তাঁর এবং উপদেষ্টা পরিষদে তাঁর সহকর্মীদের উপর দেশের “ক্ষীয়মাণ রাষ্ট্রযন্ত্র” পুনর্নির্মাণ করার দায়িত্ব দিয়েছে।
“দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা গভীর বিস্ময় ও হতাশার সাথে মুখোমুখিভাবে দেখতে পাচ্ছি সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কীভাবে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে; কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দী করে রাখা হয়েছিল; কীভাবে জনগণের অর্থসম্পদ নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল,” তিনি বলেন।
“এক কথায়, কীভাবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল,” তিনি বলেন।
ড. ইউনূস বলেন “সকল রাজনৈতিক দল” এখন স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। তবে তিনি নির্দিষ্ট করে দেশের অন্যতম বৃহৎ দল, ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কিছু বলেন নি।
গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন প্রাক্তন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগার বা পুলিশ রিমান্ডে রাখা হয়েছে। দলের অন্যান্য নেতা-কর্মীরা এখনো লুকিয়ে আছেন বা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। দলের কোন কর্মকাণ্ড নেই, এবং দেশের গণমাধ্যমেও আওয়ামী লীগের কোন প্রতিনিধির অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় না।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়ে বলেন তারা সেই অধিকার “সমুন্নত এবং সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
“আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয় ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে – এটাই আমাদের লক্ষ্য,” তিনি বলেন।
ড. ইউনূস বলেন আদালতের স্বাধীনতা এবং সাইবার জগতসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতেও তারা অঙ্গীকারবদ্ধ।
জলবায়ু পরিবর্তন
ড. ইউনূস তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সবার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সাথে ন্যায়বিচারের সম্পর্ক তুলে ধরেন।
“আমাদের যা প্রয়োজন, তা হল জলবায়ু সম্পর্কিত ন্যায় বিচার, যাতে করে দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত, উদাসীন আচরণ কিংবা এর মাধ্যমে সাধিত ক্ষতির বিষয়ে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের দায়বদ্ধ করা যায়,” তিনি বলেন।
“সাইক্লোন বা বন্যা, যেসব ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, সেগুলো থেকে ক্ষতি উপেক্ষা করা সম্ভব না। আমাদের কৃষক বা কুটিরশিল্প থেকে যারা জীবিকা অর্জন করেন, তারা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে ঝুঁকি আরও গভীর ভাবে অনুভব করেন। এই সময়েই, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ তাদের জীবদ্দশায় সবচেয়ে ভয়ানক বন্যা দেখতে পেয়েছেন,” তিনি বলেন।
এসব সত্ত্বেও, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনি গুতেরেস দেখিয়েছেন যে বর্তমানে বিশ্ব যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে থাকলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২.৭ সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের মত যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছে, তারা যাতে খাপ খাওয়াতে পারে সেজন্য “কার্যকর সম্পদ” তাদের পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
“আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। নির্দিষ্ট করে বললে, আমাদের দরকার জীবন-রক্ষাকারী প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃষি, পানি বা জনস্বাস্থ্য খাতে, যেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভাবন ও সমাধান ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে পারে,” প্রধান উপদেষ্টা বলেন।
তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বিশ্ব অর্থনীতির যোগসূত্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “নেটজিরো” বা কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য বিশ্বের সবার জন্য উপকারী করতে হলে বাংলাদেশের মত দেশকে সাহায্য দিতে হবে।
“আমি বিশ্বাস করি, সারা বিশ্ব একসাথে ‘তিন শূন্য’-এর ধারনা বিবেচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে শূন্য দারিদ্র, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি তরুণ-তরুণী চাকরি প্রার্থী না হয়ে, বরং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে। যেখানে একটা ব্যবসায়ীক উদ্যোগ সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য আনতে মনযোগী হতে পারে,” তিনি বলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণের শেষে পুনরায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ে ফিরে যান এবং বলেন মুক্তি এবং অধিকার সবার প্রাপ্য।
“বাংলাদেশের তরুণরা প্রমাণ করেছে যে, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং অধিকার সমুন্নত রাখার অভিপ্রায় কোন উচ্চাভিলাষ নয়। বরং, এটা সকলের নিশ্চিত প্রাপ্য,” তিনি বলেন।