সেনাবাহিনী-পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা এবং পূজা কমিটির সম্মিলিত উদ্যোগে মণ্ডপের স্থান বদল করে ঢাকার উত্তরায় আসন্ন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার আপাত অবসান হয়েছে।
এবছরের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ঢাকার উত্তরায় স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। সেখানকার কয়েকটি সেক্টরের মাঠে পূজা মণ্ডপ তৈরি না করার দাবিতে গত কয়েক দিন মানববন্ধন ও মিছিল করেছে স্থানীয় মুসলমানরা। যার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী ও মুসলমানদের একাংশের মধ্যে এক ধরণের উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
তবে, শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী-পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতা এবং পূজা কমিটির সম্মলিত মিটিংয়ের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হয়। মিটিং-এ এবছর ১১, ১৩ ও ৩ নম্বর সেক্টরের পরিবর্তে ৭ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণিতে (মুগ্ধ চত্বর) দুর্গাপূজা মণ্ডপ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এই বিষয়ে বাংলাদেশে পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ওটার সমাধান হয়ে গেছে। পূজা হবে, তবে অন্য একটা জায়গায় হবে।” (সন্তোষ শর্মা বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক, কালবেলার সম্পাদক।)
“সেনাবাহিনী-পুলিশ ও রাজনৈতিক এবং পূজা কমিটির নেতারা সম্মলিতভাবে মিটিং করে পূজার স্থান পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে” বলে উল্লেখ করেন সন্তোষ শর্মা।
উত্তরার স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, বিগত ২ বছর ১১ নম্বর সেক্টরের মাঠে দুর্গাপূজা হয়ে আসছিল। সেই অনুযায়ী এবার সেখানে পূজা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সনাতন ধর্মালম্বীরা।
কিন্তু এবছর সেখানে পূজা মণ্ডপ না করার দাবিতে গত কয়েক দিন মিছিল-মানববন্ধন করেছে স্থানীয় মুসলমানরা। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর উত্তরা দিয়াবাড়ি ক্যাম্পের সামরিক কর্মকর্তা বৈঠক করে ১৩ নম্বর সেক্টরের মাঠে পূজা করার সিদ্ধান্ত দেয়।
কিন্তু সেখানেও পূজা না করার দাবিতে স্থানীয় কিছু লোক মানববন্ধন ও মিছিল করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে এবার স্থান পরিবর্তন করে ৭ নম্বর সেক্টরে পূজা মণ্ডপ করার সিদ্ধান্ত হয়।
সেক্টর ১১ থেকে ১৩, পরে ৭-এ গিয়ে সমাধান
স্থানীয় পূজা কমিটির নেতারা বলছেন, ২০১৮ সালের পূজা কমিটি একটি চুক্তি করেছিল যে, 'একেক বছর, একেক সেক্টরে ঘুরে-ঘুরে' পূজা হবে।
ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি উত্তরা পশ্চিম শাখার সাধারণ সম্পাদক কমল কান্তি সরকার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “গত ২০২২ এবং ২০২৩ সালে আমরা ১১ নম্বর সেক্টরের মাঠে পূজা করেছিলাম। সেই ধারাবাহিকতায় এবার আমরা মাঠ বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে চিঠি দেই।”
“ওই সময় ১১ নাম্বার সেক্টরে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ধর্মীয় লোক, যাদের অনেককে আমরা চিনি না, তারা একটা মানববন্ধন করে। এই অজুহাতে ১১ নম্বর মাঠে পূজা করতে দেওয়া হবে না” বলে যোগ করেন কমল কান্তি।
১১ নম্বর সেক্টরের স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ দাবি করে, "পূজার কারণে ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া নষ্ট হচ্ছে। পূজার কারণে মাঠ বন্ধ থাকলে ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা করতে পারে না। মানুষ হাটাহাটি করতে পারে না।"
কমল কান্তি বলেন, “১১ নম্বর সেক্টরের এই অবস্থার কারণে আমাদেরকে একদিন উত্তরা দিয়াবাড়ি আর্মি ক্যাম্পে ডাকা হয়। সেখানে আর্মির কর্মকর্তা মেজর খন্দকার জাহিদুল হক বললেন যে, ১১ নম্বর নিয়ে যেহেতু কথা উঠছে, আপনারা ১৩ নম্বরে পূজা করেন। আপনারা প্রস্তুতি নেন।”
“তার একদিন পরে ১৩ নম্বর সেক্টরে মানববন্ধন ও ব্যানার লাগানো হয় পূজা করতে দেওয়া হবে না। এরপর স্থানীয় থানা থেকে আবার ডাকা হয়, সেখানে বৈঠকের পরে আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয়- উত্তরা জমজম টাওয়ারের পাশে অথবা ১৫ নম্বর সেক্টরে পূজা করার,” বলে জানান কমল কান্তি।
১১ নম্বর ও ১৩ নম্বর সেক্টরে মণ্ডপ তৈরিতে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশের আপত্তির প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে পূজা না করার কথা বলেন কর্তৃপক্ষকে। কমল কান্তি বলেন, “তখন আমরা বললাম এই দুই জায়গা পূজা করার উপযোগী নয়, আমরা এবার পূজা করবো না।"
পরবর্তীতে পশ্চিম থানা ও আর্মি ক্যাম্পের সহযোগিতায় ৭ নম্বর সেক্টরে পূজা করার সিদ্ধান্ত হয়।
উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “২০১৮ সালে পূজা কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের একটা চুক্তি ছিল যে, প্রত্যেক বছর ঘুরে-ঘুরে প্রতিটি সেক্টরে পূজা হবে। অর্থাৎ এক জায়গায় হবে না। তারপরও প্রতি বছর ১১ নম্বর সেক্টরে পূজা হতো। কিন্তু ওই সেক্টরের পূজার মাইকের কারণে বাচ্চাদের লেখা পড়ার সমস্যা হয়। যার কারণে স্থানীয়রা সেখানে পূজা না করার দাবি তোলে।”
তিনি আরও বলেন, “সেখানে লেখা ছিল প্রত্যেক বছর ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন সেক্টরে হবে। কিন্তু উনারা এক জায়গায় করতো, এটাই ছিল সমস্যা। এরপর আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। এটার সমাধান হয়েছে পূজা হবে। এবার সিদ্ধান্ত হয়েছে ৩ এবং ৭ নম্বর সেক্টরের মাঝখানে রবীন্দ্র সরণিতে পূজা হবে।"
পুলিশের দাবি মিছিলের ভিডিও পুরানো
উত্তরা ১১ নম্বর, ১৩ নম্বর এবং ৩ নম্বর সেক্টর মাঠে পূজা করতে না দেওয়ার দাবিতে কয়েকটি মানববন্ধন ও মিছিলের ভিডিও গত কয়েকদিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও স্থানীয় পুলিশ বলছে, এসব ভিডিও পুরানো, "কেউ পুরাতন এসব ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে।"
“পূজা না করতে দেওয়ার দাবিতে কোনো মিছিল হওয়ার তথ্য জানা নেই“ বলে উল্লেখ করেন হাফিজুর রহমান।
১১ নম্বর সেক্টরে একটা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন হয়েছে বলে উল্লেখ করে হাফিজুর রহমান বলেন, "সেখান থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, পূজা যেহেতু একেক বছর একেক জায়গায় করার কথা, এই বছর যেন অন্য জায়গায় করা হয়। সেখানে আমরা ছিলাম। সেখানে কোনো মিছিল হয় নাই।”
পূজা মণ্ডপে নিরাপত্তা
বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজায় “সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা” নেয়া হবে এবং পুলিশ “উচ্চ সতর্কাবস্থায়” থাকবে বলে সোমবার (২৩শে সেপ্টেম্বর) জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।
আইজিপি জানিয়েছেন, দুর্গাপূজার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, পূজা -পূর্ব, পূজা উদযাপন ও পূজা পরবর্তী প্রতিমা বিসর্জন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় উৎসব দুর্গাপূজায় মাদরাসার ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে রাজি বলে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) জানান ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, "মাদরাসার ছাত্ররা বলেছেন পূজা কমিটি যদি চায় তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে সম্মত আছেন।"
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) একটি সংবাদ সম্মেলনে অনুরোধ করেছে যাতে পেশাদার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, কোনও প্রতিষ্ঠানের ছাত্র দিয়ে নয়।
পুলিশের নিরাপত্তা প্রস্তুতির ঘোষণা এসেছে সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর আর মন্দিরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পটভূমিতে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ১৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) জানিয়েছে, ৪ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
তাদের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মধ্যে ৯ জনকে হত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ/গণধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ; ৯১৫টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; বসতবাড়ি দখল একটি; ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও এরই মধ্যে বাংলাদেশের একাধিক স্থানে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।
এবারের দূর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের ভয়, আতঙ্ক ও মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এবার গত ১৫ দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুর হচ্ছে” উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, "সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তো একটা ট্রমার মধ্যে আছে। তারা পূজা করতেও চায়, আবার করতে গেলে হামলার আশঙ্কা মধ্যেও আছে। এখন তারা দোটানায় মধ্যে আছে।”
“এবার পূজা কতটা উৎসবমুখর হবে কিনা বলতে পারবো না। তবে, পূজাকে করে ভয় এবং আতঙ্কে আছে সংখ্যালঘুরা” বলে যোগ করেন রানা দাশ।
২০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ার সেনেটর বেন কার্ডিন এবং সদস্য সেনেটর ক্রিস মারফি, সেনেটর ভ্যান হলেন ও সেনেটর জেফ মার্কলি যৌথভাবে এক চিঠিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া ও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠকে দুই নেতা দু'দেশের অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ ছাড়াও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।
এবছর বাংলাদেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি স্থানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
(এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ইউএনবি থেকে নেওয়া হয়েছে।)