একজন শিক্ষয়িত্রী বলছেন তাঁকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে তার ছাত্র ছাত্রীরা। তিনি প্রথমে স্বাক্ষর দিতে প্রস্তুত ছিলেন না বলে তার আঙুল ধরে টিপ সই নেয়ার চেষ্টা করে। পরে তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন।
“ যদি আমি সিগনেচার না করি তা হ’লেতো তারা আমাকে ফিজিকাল হ্যারাসমেন্ট করবে। তারাতো তাহলে আমাকে আরও ফিজিকালি অ্যাসল্ট করতো। তারা নাকি প্রিন্সিপালকেও তাই করেছে। আমি দেখি নাই কারণ আমি আমাদের রুমে তালাবদ্ধ ছিলাম। আমার সামনে সাদা একটা কাগজ ধরিয়ে বলে আপনি রেজিগনেশান লেটার লেখেন। আমি বললাম আমি লিখবো না। তখন আঙ্গুল চেপে ধরলো । আমি বাধ্য হলাম সই করতে,” তিনি বলেন।
চকরিয়া সরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থী তার ফেইসবুকে লিখেছেন ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইন্দ্রজিৎ বড়ুয়া পদত্যাগ করেছেন। এই শিক্ষার্থী তার এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের পদত্যাগে কষ্ট পেয়েছেন এবং লিখেছেন, “জানিনা কখন এই দেশ থেকে রাজনীতির প্রতিহিংসাটা চলে যাবে”।
কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জুবায়দা নাসরিনের সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে । ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করছে তাদেরই কিছু শিক্ষার্থী এবং সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্য কিছু দুস্কৃতরাও।
“মূলত সংখ্যালঘু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এই নিপীড়ন চলছে তবে অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও চলছে যাদেরকে কোন না কোন ভাবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক বলে মনে করা হচ্ছে,” তিনি বলেন।
“ বিশেষত হিন্দু শিক্ষকদের টার্গেট করা হচ্ছে দুটি কারণে, প্রথমত হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাব যারা পোষণ করে তারা সেটা করছে, আর দ্বিতীয়ত যারা মনে করে যে হিন্দুরা হচ্ছে আওয়ামী লীগের সমর্থক,” বলেন জুবায়দা নাসরিন।
বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের সভাপতি রবীন্দ্র ঘোষ ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান সংখালঘুদের নিরাপত্তা ও তাদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি উদ্বিগ্ন। তাঁর কাছে অনেকে আবেদন জানান সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এমনই একজন হচ্ছেন, গাইবান্ধা শহরের দৈনিক জনসংক্ষেপ পত্রিকার প্রকাশক দীপক পাল।
পাল মাইনরিটি ওয়াচের কাছে পাঠানো আবেদনে লিখছেন, গত ৫ আগস্ট বিকেল ২০/২৫ জনের একটি সশস্ত্র দল লাঠি সোডা ও লোহার রড,ছোড়া, দা কুড়াল নিয়ে অতর্কিত ভাবে গাইবান্ধা জেলা শহরের পুরাতন বাজারে অবস্থিত তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক জনসংকেত পত্রিকা অফিসে এবং নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে লুটপাট ও ভাংচুর করে।
“তারা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আসবাব পত্র ভাংচুর করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং নগদ টাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। তারা আমার মোটর সাইকেলটিতে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। এসময় আমি পালিয়ে নিরাপদ স্থানে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি,” দীপক পাল বলেন।
কথা বলছিলাম উদীচির সাধারণ সম্পাদক অমিত দে’র সঙ্গে । তিনি বলেন যে বিশেষত অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন এবং কেবল অমুসলিম সম্প্রদায়েরই নন , মুসলিমদের মধ্যে যারা সংখ্যা লঘু যেমন কাদিয়ানিরা , তাদের উপরও আঘাত এসেছে। আর শিক্ষকদের উপর যে আঘাত এসেছে তা কেবল মাত্র সংখ্যালঘুদের উপরে নয়, প্রগতিশীল শিক্ষকদের অনেককেই বাধ্য করা হয়েছে পদত্যাগ করতে ।
“ আমি একজন শিক্ষকের কথা যদি বলি, আমি দেখেছি যে তিনি লিখেছেন, ‘ প্রিয় বাংলাদেশ, পদত্যাগ করলাম, তারপর স্বাক্ষর দিয়ে তিনি ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন। অনেকে কেঁদেছেন,” অমিত দে বলেন।
এ দিকে গত ৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা ও হয়রানি করা থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান । তিনি বলেন, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা ধরনের হয়রানির ঘটনা এখনো অব্যাহত রয়েছে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
“শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছ, যেকোনো ধরনের বেআইনি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থেই নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করতে হবে,” বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
অধ্যাপক জুবায়দা নাসরিন বলেন, “শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন চালিয়ে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করলো সেটার মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীনতা ও ন্যায় বিচার প্রাপ্যতা ও সমতা কিন্তু এখন যদি অটোক্র্যসির বিরুদ্ধে মবোক্র্যাসি চালানো হয় তা হলে সেটাতো বিপরীত বিষয়। নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আমলে নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু যে মবোক্র্যাসির মাধ্যমে তারা এটি করতে চাইছেন সেটি কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।”