অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে পরিস্থিতি থমথমে, নিহত চার, ১৪৪ ধারা জারি


বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে সংঘর্ষের পরে মানুষ ভাঙচুর করা দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে সংঘর্ষের পরে মানুষ ভাঙচুর করা দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার জন মারা গেছে। এই ঘটনায় অর্ধশতাধিকের বেশি মানুষ আহত হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন।

কী ঘটছে পার্বত্য এলাকায়

বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ায় এক বাড়িতে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মো. মামুন নামের যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মামুনের স্বজনরা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য পানখাইয়া পাড়াবাসীকে দায়ী করেছেন।

আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বার্তায় জানায়, "এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে দীঘিনালা কলেজ হতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর কতিপয় সন্ত্রাসী মিছিলের ওপর হামলা করে ও ২০-৩০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে। এ প্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নি সংযোগ করে।"

এরপর খাগড়াছড়ির অন্যান্য অংশ ও রাঙামাটিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

উত্তেজনা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি কাজ করেছে বলে তাদের বার্তায় উল্লেখ করে।

একই বার্তায় আইএসপিআর দাবি করে, “১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল রাত সাড়ে ১০ টায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফ (মূল) এর নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। উক্ত গোলাগুলির ঘটনায় ৩ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।”

এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, সংঘর্ষের ঘটনায় চারজনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতেরা হলেন, খাগড়াছড়িতে জুনান চাকমা, ধনঞ্জয় চাকমা, রুবেল ও রাঙামাটিতে অনিক কুমার চাকমা।

বেশ কিছু সংখ্যক আদিবাসী পরিবার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।

চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় 'ভয়াবহ দাঙ্গায়' রূপ নিতে পারে বলে আইএসপিআর পক্ষ থেকে তাদের বার্তায় সতর্ক করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রোজালিন শহীদ চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত (খাগড়াছড়িতে) ৩ জন মারা গেছে। অনেকে আহত হয়েছে। যার ফলে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।”

রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোতাছেম বিল্লাহ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আজ (শুক্রবার) সকাল থেকে রাঙামাটিতে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ফলে পৌর এলাকায় বেলা একটা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।”

আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী রানী ইয়ান ইয়ান রাঙামাটিতে পরিস্থিতি 'আপাতত শান্ত' আছে তবে শহরের পাহাড়ি অধ্যুষিত মহল্লাগুলোতে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন।

পাহাড়িদের এলাকাতে বাঙালিদের হামলা, ঘরবাড়ি ও বৌদ্ধ মন্দিরে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে এই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

খাগড়াছড়িতে মোবাইল ইন্টারনেট এর গতি হামলা চলাকালীন একটি সময়ে 'অত্যন্ত কম' কিন্তু ব্রডব্যান্ড 'স্বাভাবিক' ছিল বলেও জানান তিনি। তবে, রাঙামাটিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল ছিল।

নিরাপত্তা জোরদারে এলাকায় এখন যৌথভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী নিয়োজিত রয়েছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে সংঘর্ষে নিহতের লাশ হাসপাতালে রাখা। ২০সেপ্টেম্বর, ২০২৪।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে সংঘর্ষে নিহতের লাশ হাসপাতালে রাখা। ২০সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

আদিবাসী নেতারা কী বলছেন

প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর পাহাড়িদের উপর আরও যে হামলা হওয়ার আশংকা ছিল সেটি ঠেকানোয় প্রশাসনের পদক্ষেপের জন্য সরকারের ধন্যবাদ প্রাপ্য বলে জানিয়েছেন আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী রানী ইয়ান ইয়ান।

এই পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও 'মিলিটারির নির্বিচারে গুলিবর্ষণে' হতাহতের ঘটনা অনুসন্ধানে দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবী জানান তিনি।

সেইসাথে হতাহতের পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় ভাবে যথোপযুক্ত সহায়তা দেয়া, হামলার শিকার পাহাড়িদের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া, এবং সাম্প্রদায়িক হামলা চলাকালে "কালক্ষেপণ না করে" আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে হামলা প্রতিহত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেদিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ইউনাইটেড পিপল'স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা এই ঘটনা পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের ধারাবাহিকতা বলে উল্লেখ করে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আসলে পাহাড়ে এই ঘটনা তো নতুন না। ধারাবাহিকভাবে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। গতকাল যে ঘটনা তাও পরিকল্পিত ছিলো”- বলে দাবি তার। (পাহাড়ে) সেনা শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য, তাদের এখানে থাকা দরকার তা প্রমাণ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে।”

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমাও “সেখানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেটা খুবই 'সূক্ষ্ম পরিকল্পিতভাবে’ করানো হচ্ছে”- বলে দাবি করেন।

মাইকেল চাকমা ও অঙ্কন চাকমা মনে করেন পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে যে 'রাজনৈতিক সমস্যা' রয়েছে, তা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।

মাইকেল চাকমা বলেন, "কোনো সিঙ্গেল উদ্যোগে এটার সমাধান সম্ভব নয়। পার্বত্য অঞ্চল মূল সমস্যার একটা অংশ মাত্র এসব ঘটনা। সেখানে রাজনৈতিক যে সমস্যা, সেটার রাজনৈতিক সমাধান না হলে আজকে একটি সমস্যার সমাধান করবেন, কালকে আরেকটি সমস্যা দেখা দিবে।”

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে সংঘর্ষের পরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়৷ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে সংঘর্ষের পরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়৷ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

সরকার কী বলছে

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি ও শুক্রবার রাঙামাটিতে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে কাজ করছে উল্লেখ করে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

“সরকারের পক্ষ থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে”- উল্লেখ করা হয় ওই বার্তায়।

এই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত সকল নাগরিককে শান্ত থাকার আহবান জানাচ্ছি। আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিবেন না। অপরাধীদের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করা হবে।"

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ঘটনা প্রসঙ্গে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “যেভাবে হোক একটা ঘটনা ঘটে গেছে। এখন এই ঘটনাকে সমাধান করতে হবে। আমরা বাংলাদেশের এই সময়ে দেখতে চাই না, আরেকটি ঘটনার জন্ম হোক।"

সুপ্রদীপ চাকমা শনিবার পার্বত্য এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন বলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে নিশ্চিত করেন।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শন করবেন।

প্রতিনিধি দলে আরও থাকছেন এই দুই উপদেষ্টার পাশাপাশি আরও থাকছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।

সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, এই সফরের মূল লক্ষ্য "বিভাজন দূর করা।”

পার্বত্য এলাকায় পাহাড়িদের উপর হামলা এবং ঘরবাড়ি ও দোকানে আগুন দেওয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিল করেছে বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা।

পার্বত্য জেলাগুলোতে (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি) দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সর্বব্যাপী উপস্থিতি রয়েছে।

সেখানে সামরিক প্রশাসন জেলাগুলোর বেসামরিক প্রশাসনের সাথে যুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির কারণ হিসাবে বলা হয় তা ঐ এলাকায় বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রিডম হাউস পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে।

সংগঠনের এশিয়া ধর্মীয় ও জাতিগত স্বাধীনতা কর্মসূচির প্রধান নোলেন ডেইবার্ট বলেছেন, "মঙ্গলবার থেকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদিও এটা সত্য যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে দেশে পুলিশের প্রশাসনিক কার্যকারিতায় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাটিতে দেশে পুলিশ প্রশাসনের অভাবই চোখে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে সেনাবাহিনী সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। দেশটিতে সংঘাত ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই বেসামরিক বাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিতে হবে যারা জাতি বা ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত বাংলাদেশিদের ন্যায্যভাবে সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।"

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন মাসুদ ফারিভার।)

XS
SM
MD
LG