অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

যুদ্ধ বিধ্বস্ত মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য


ফাইল- মিয়ানমারের দিকে মিয়ানমারের সরকারি সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে আর অন্যদিকে চীনের দিকে নানসান শহরে চীনা সীমান্তে চীনের পতাকা । আগস্ট ৩০,২০০৯।
ফাইল- মিয়ানমারের দিকে মিয়ানমারের সরকারি সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে আর অন্যদিকে চীনের দিকে নানসান শহরে চীনা সীমান্তে চীনের পতাকা । আগস্ট ৩০,২০০৯।

চীন, তার কথায় মিয়ানমারে “ বাইরের হস্তক্ষেপ” সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। দেশটি বেইজিং ও ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের মাঝখানে পড়ে গেছে।

এই সতর্কবার্তা এমন এক সময়ে এলো যখন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ামনমারের গণতন্ত্রপন্থি শক্তির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করছে আর যার ফলে বেইজিং এ উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন মিয়ানমারে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীর সংশয় রয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, লাওস, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে ১৬ আগস্ট একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওয়াং জোর দিয়েই বলেন যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বাইরের হস্তক্ষেপ, বিশেষত এই অঞ্চলের বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকা উচিৎ।

মিয়ানমারে চীনা দূতাবাস এবং রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদ মাধ্যম এই অবস্থানের দ্রুত প্রতিধ্বণি তোলে এবং জোর দিয়ে বলে একান পক্ষেরই উচিৎ হবে না “বহির্দেশীয় হস্তক্ষপের” সীমা লংঘন করা।

এই বৈঠকের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাবৃন্দ ও মিয়ানমারের বিরোধীদলের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল আলোচনা হয় যেখানে ওয়াশিংটন অসামরিক সরকারে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে তাদের সমর্থন পূনর্ব্যক্ত করে।

ওয়াং যদিও সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেননি, তার মন্তব্যগুলিকে ওয়াশিংটনের বর্ধিত সম্পৃক্ততার জবাব বলেই মনে হয়েছে।

চীনের অনাস্থা

ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের একজন অধ্যাপক জাকারি আবুজা মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চীনের অনাস্থার কথা তুলে ধরেন। আবুজা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ চীনের দৃষ্টিতে তারা মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করে। সমস্যাটা হচ্ছে চীনারা মিয়ানমারের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায় না”।

চীনে অবস্থিত চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক বিষয়ক একজন অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক হ্লা কিয়াও জাও এই অনুভূতির প্রতিধ্বণি তুলে বলেন চীন অন্য কোন দেশের চাইতে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও জাতিগোষ্ঠীগত সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় চীনের ভূমিকা সম্পর্কে হ্লা কিয়াও জাও বলেন, “ যেমনটি এ বছরের গোড়াতে চীনের মধ্যস্ততার প্রচেষ্টায় দেখা গেছে মিয়ানমার সংকটের ব্যাপারে চীন নেতৃস্থানীয় হয়ে থাকতে চায়”।

মন্তব্যের জন্য ভয়েস অফ আমেরিকার অনুরোধে , ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাস মিয়ানমারে অভ্যন্তরীন অশান্তি ও গৃহযুদ্ধকে উস্কানি দেয় এমন কর্মকান্ডের বিরোধীতায় চনের অবস্থান পূনর্ব্যক্ত করে। একটি ইমেইলে দূতাবাসটি বলে, “ বাইরের শক্তি দ্বারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন বিষয়ে ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপের বিরোধীতা করে।

অধ্যাপক আবুজার মতে মিয়ানমার সংকট সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সহযোগিতার খুব বেশি সম্ভাবনা নেই যদিও উভয় পক্ষেরই লক্ষ্য অভিন্ন।

আবুজা বলেন, “ বস্তুত আমরা উভয়ই চাই অনেকটা একই জিনিষ- সামরিক শাসনের অবসান, গৃহযুদ্ধের অবসান এবং একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন । কিন্তু এই স্বল্প মেয়াদে আমি দেখছি খুব কম সহযোগিতাই এগিয়ে যাচ্ছে”।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র মতপার্থক্য

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অফ পিস ‘এর সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণের মতে এই বিভাজন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ব্যাপকতর উত্তেজনাকে তুলে ধরে। যদিও উভয় শক্তিই মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা চায়, তাদের পদ্ধতিটা একেবারেই ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে, যেমন সে দেশর সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তা ছাড়া ২০২১ সালের অভ্যূত্থানের পরে যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট অফ ২০২২ অনুমোদন করে যেখানে গণতন্ত্রপন্থি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলিকে মারণাস্ত্র নয় এমন সাহায্য প্রদান এবং জান্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরোধী পক্ষ দ্য ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্ণমেন্ট বা এনইউজিকে ওয়াশিংটনে তাদের লিয়াজোঁ দপ্তর খোলার অনুমতি দেয় যদিও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক ভাবে এনইউজিকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

১৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি অনুযায়ী কাউন্সেলার টম সালিভান ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সহকারি প্রশাসক মাইকেল শিফার মিয়ানমারে অন্তর্ভুক্তিমূলক ফেডারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠন করার জন্য গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলির প্রশংসা করেছেন এবং এই গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন জানানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি আবার নিশ্চিত করেছেন।

হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতি অনুযায়ী হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সালিভান এবং চীনের ওয়াং ২৭-২৮ আগস্টের আলোচনার সময়ে এই বিষয়টির দিকে নজর দেন তবে ঐ বিবৃতিতে বিস্তারিত আর কিছু জানানো হয়নি।

মিয়ানমারে চীনের কৌশলগত স্বার্থের পেছনে রয়েছে তার প্রচুর অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং ভারত মহাসাগরে প্রবেশের জন্য দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান।

বিশেষত চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়াটিভ বা বিআরআই’এর পরিপ্রেক্ষিতে হ্লা কিয়াও জাও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, “ চীন যেহেতু প্রতিবেশি রাষ্ট্র , মিয়ানমারে তার বড় রকমের আগ্রহ রয়েছে। এটা ব্যাপক ভাবেই মনে করা হয় যে ভারত মহাসাগরের নাগালের মধ্যে যাওয়ার লক্ষ্যে চীনের যে পরিকল্পনা তার জন্য মিয়ানমার খুব গুরুত্বপূর্ণ।

হ্লা কিয়াও জাও বলেন, “ বিআরআই’এ মিয়ানমারের সম্পৃক্ততা , যেমনটি চীন মনে করেছিল, ততো সহজ নয়। আর সে জন্য চীন মিয়ানমারে যতটা দ্রুত সম্ভব তার প্রকল্প শেষ করতে চায় । আর এটি অর্জনের জন্য আমার বিশ্বাস মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করতে এবং শান্তি নিশ্চিত করতে চীন তার ক্ষমতায় যা আছে সবটাই প্রয়োগ করবে”।

মিয়ানমারের একজন প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী মে সাবে পিয়াও , যিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে জাতিসংঘে সোচ্চার তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের তাৎপর্যপূর্ণ শক্তির কথা তুলে ধরেন এবং বলেন যে বেইজিং’এর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তির কারণে চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে পশ্চিম লড়াই করেছে। তিনি বলেন , “ পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলিসহ, বিশ্ব জুড়ে দেশগুলি চীনের ক্রবর্ধমান আধিপত্যকে কার্যত সরিয়ে দিতে পারছে না”।

XS
SM
MD
LG