অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

অনিশ্চিয়তার মধ্যে বসবাস: রাষ্ট্র-কর্তৃক জোরপূর্বক গুম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারগুলোর সংগ্রাম


ডঃ মুহাম্মদ আকবর মারিকে ২০১০ সালে পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনী বেলুচিস্তানে তার ক্লিনিক থেকে তুলে নিয়ে যায়।(ভিওএ)
ডঃ মুহাম্মদ আকবর মারিকে ২০১০ সালে পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনী বেলুচিস্তানে তার ক্লিনিক থেকে তুলে নিয়ে যায়।(ভিওএ)

দক্ষিণ এশিয়ায় বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য তাদের স্বজনরা বছরের পর বছর, কখনও কখনও কয়েক দশক ধরে, তাদের প্রিয়জনের ভাগ্য জানতে মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছেন।

স্বামীরা মৃত বা জীবিত কিনা তা নিশ্চিত না হওয়ায় তাদের স্ত্রীরা কখনও কখনও "অর্ধ বিধবা" নামে পরিচিত হয়। অনিশ্চিয়তা তাদের কুঁকড়ে খায়, তবুও এই অনিশ্চিয়তাই তাদের সামনে চালিয়ে নিয়ে যায়। তাদের অবিরাম অনুসন্ধানে প্রত্যেকটি দেখা দেওয়ার গুজব, প্রতিটি আশার গুঞ্জন এক প্রকার অবসান পাওয়ার তাদের জীবনের একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে।

ফারজানা আক্তারের স্বামী পারভেজ হোসেনকে ১১ বছর আগে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তিনি একজন বিরোধীদলীয় কর্মী। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে জোরপূর্বক গুম হওয়া ৬০০ জনেরও বেশি ব্যক্তির মধ্যে তিনি একজন । যদিও তাদের মধ্যে কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয় বা মৃত বলে জানানো হয়, ১০০ জনেরও বেশি মানুষের খোঁজ নেই।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের মুক্তির প্রতি আশা বেড়ে যায়। ঢাকার একটি কুখ্যাত ডিটেনশন সেন্টার থেকে তিনজনকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু হতাশ পরিবারগুলি যখন সেখানে ছুটে যায়, তারা কেবল খালি কারাঘর খুঁজে পায়।

তারপরও আক্তার তার স্বামী বেঁচে আছেন বলে আশায় বুক বেঁধে আছেন।

তার মেয়ে আবিদা ইসলাম হৃদির বয়স মাত্র ২ বছর যখন তার বাবা নিখোঁজ হন। ডিটেনশন সেন্টারের একটি ভিডিও দেখে তিনি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান।

তিনি বলেন, " মানুষ সেখানে কিভাবে থাকতে পারে?"

তবুও, তার মায়ের মতো, সেও আশা ধরে রাখে যে তার বাবা বেঁচে আছেন।

হৃদি বলে "আমার মা বলেছেন আমার বাবা আছে। সবাই বলে তারা আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু কোথায় আছে বলে না। সবাই শুধু বলে, তোমার বাবা আছে। "

ভিওএ-এর সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের প্রায় ডজন খানেক পরিবারের সদস্যদের কন্ঠে তাদের এই বেদনামিশ্রিত আশা ধ্বনিত হয়।

মানবাধিকার কর্মীদের কাছে এই অনুভূতিটি খুবই পরিচিত।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, "শ্রীলঙ্কায় ২০০৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়। তারপরও আমরা এমন মায়েদের সাথে দেখি যারা এখনও আশা করছেন তাদের ছেলেরা হয়তো গোপন কোনোও জায়গায় গ্রেপ্তার হয়ে আছে এবং তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে।"

বলপূর্বক গুম একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। নিরাপত্তা বাহিনী ভুক্তভোগীদের রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় বা তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের ভাগ্য অজানা রয়ে যায়: তাদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা হয়, মুক্তি দেওয়া হয় বা তারা হেফাজতে মারা যান। ১৯৬০-এর দশকে লাতিন আমেরিকার সামরিক শাসক এই কুখ্যাত অনুশীলনটি শুরু করেন। এই বলপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো দক্ষিণ এশিয়াকে কয়েক দশক ধরে জর্জরিত করে রেখেছে।

পুরো অঞ্চল জুড়ে গুমের সংখ্যা বিশাল। আফগানিস্তানে, ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জোরপূর্বক গুম করা হয়। শ্রীলঙ্কায় ১৯৮০-এর দশকে প্রায় ৬০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ জনের মতন মানুষ গুম হয়েছে। ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৮,০০০ টি ঘটনা তালিকাভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ২০০৪ সাল থেকে ৭,০০০টি ঘটনা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

জোরপূর্বক গুম করার অভিযোগে অভিযুক্ত সরকারগুলো গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে। হাসিনার সরকার প্রায়শই জোর দিয়ে বলে কিছু ভুক্তভোগী ফৌজদারি অভিযোগ এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছে এবং জোরপূর্বক গুম থেকে সকল ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনোও ধরণের সমাপ্তি না পাওয়াই এই প্রথার সবচেয়ে খারাপ দিক : পরিবারের সদস্যরা কোনও রূপ খবর না পাওয়ার চেয়ে অন্তত তাদের লাশ হলেও খুঁজে পেতে চায়।

ফাহিমা বিবির ছেলে আব্দুল খালিদ, ২০১২ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে নিখোঁজ হন। ফাহিমা বিবি বলেন, "এর চেয়ে কঠিন আর কিছু নেই। যদি একজন মানুষ মারা যায়, আপনার মন একটা শেষ সান্তনা পায়, কিন্তু, সে যে মৃত না জীবিত তা জানতেই না পারাটা ?"

পরিবারের উপর এর কারণে কিরকম দীর্ঘমেয়াদী মানসিক প্রভাব পড়ে তা অনিশ্চিত। ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রিয়জনের মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা করা ব্যক্তিদের তুলনায় এই পরিবারগুলোর মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, বিষণ্নতা এবং চরম শোক বেশি দেখা যায়। তবে, আরও একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে যে প্রমাণগুলি অমীমাংসিত।

ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই পুরুষ, তাদের সন্তানরা তাদের ক্ষতির ভার বহন করে, এমনকি সেই ছোট বয়সী সন্তানরাও যারা তাদের বাবাকে ভালোভাবে চিনেও না তারাও অভাব অনুভব করে। তারা ছবি, স্মৃতিচিহ্ন এবং পারিবারিক গল্পের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে জানতে পারে এবং তাদের বাবার সাথে একটি কাল্পনিক বন্ধন তৈরি করে। এই শূন্যতা আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে যখন তারা তাদের সমবয়সীদের তাদের বাবার সাথে দেখে।

ফাহমিদা বালোচ তার বাবা ডা মোহাম্মদ আকবর মরি সম্পর্কে বলছেন। ডা মারিকে পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনী বেলুচিস্তানে তার ক্লিনিক থেকে ২০১০ সালে তুলে নিয়ে যায়। (ভিওএ)
ফাহমিদা বালোচ তার বাবা ডা মোহাম্মদ আকবর মরি সম্পর্কে বলছেন। ডা মারিকে পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনী বেলুচিস্তানে তার ক্লিনিক থেকে ২০১০ সালে তুলে নিয়ে যায়। (ভিওএ)

ফাহমিদা বালুচের বয়স যখন ২ বছর, তখন তার বাবা ডক্টর মুহম্মদ আকবর মারিকে ২০১০ সালে পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনী বেলুচিস্তানে তার ক্লিনিক থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে তাকে বলা হয় যে তার বাবা ব্যবসায়িক সফরে গিয়েছেন। ফাহমিদার যখন ৮ বছর বয়স হয়, বালুচের মা তার কাছে সত্য প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, "আমি আগে জানতাম না বলপূর্বক গুম হওয়ার অর্থ কী।"

ছোট ছোট জিনিসে সে তার বাবার অনুপস্থিতিকে তুলে ধরে: বাবা তাদের বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া শিক্ষকরা ছাত্রদের তাদের বাবাকে স্কুলে নিয়ে আসতে বলা।

বালুচ বলেন, "আমি কিভাবে তাদের বলতে পারতাম আমার বাবা কোথায়?"

তিনি তার ইসলামী বিশ্বাস থেকে শক্তি ও আশা নেন।

তিনি বলেন, "আমার মা বলেছেন, 'তুমি আশা ধরে রাখো, তিনি অবশ্যই ফিরে আসবেন।' আমি প্রার্থনা করি। প্রার্থনা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।"

এই আশা অন্যদের এই সময়ের মধ্যের বছরগুলো পার করে দিতে সাহায্য করে।

ফরহাদ আশকিয়ারের বাবা ১৯৭৯ সালে কাবুলে গুম হন। ফরহাদের বয়স তখন ২ বছর। সে বড় হওয়ার সাথে সাথে পারিবারিক গল্প থেকে তার অনুপস্থিত বাবা সম্পর্কে জানতে পারে যে তিনি একজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী এবং একজন ভাল কুস্তিগীর ছিলেন।

বালুচের মতো অন্যান্য বাচ্চাদের তাদের বাবার সাথে দেখে তার বাবার শূন্যতার অনুভূতি আরও বেড়ে যায়।

XS
SM
MD
LG