গ্রীষ্মের সেই রাতে আবহাওয়া ছিল হাল্কা গরম, বেশ আরামদায়ক। সময় ২০২০ সাল, এবং জার্মানিতে কিছু দিন আগে কোভিড-১৯ এর লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে। ওমর দিয়ালো এবং নিজের দেশ গিনি থেকে আসা তার দুই বন্ধু ঈদ –উল আজহা উদযাপন করতে বের হয়েছিলেন।
“আমারা জীবন উপভোগ করছিলাম, গান শুনছিলাম, রাতে শহরের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম - আমরা কেবল আবারও এক সঙ্গে হয়ে দারুণ সময় কাটাতে চেয়েছিলাম,” ২২-বছর বয়সী দিয়ালো এই কথাগুলো অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য থুরিঞ্জিয়ার এরফুরট শহরে।
দিনটা যে তাদের এভাবে শেষ হবে তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। দিয়ালো ও তার বন্ধুরা হঠাৎ কালো পোশাক পরা তিনজন শ্বেতাঙ্গর মুখোমুখি হন।
দিয়ালোর মনে পড়ল তারা চিৎকার করে বলছিল, “এখানে তোমরা কী চাও, হারামি বিদেশী, বেরিয়ে যাও!
“প্রথমে সেখানে তিনজন, তারপর পাঁচ, সাতজন- একপর্যায়ে তারা আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। আমরা দৌড়ে পালাতেও পারছিলাম না। এরপর তারা আমাদের ধাওয়া করতে শুরু করলো।”
এক পর্যায়ে দিয়ালো পুলিশকে ফোন করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে কর্মকর্তারা যখন পৌঁছালো তখন হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। তাঁর এক বন্ধুকে এতটাই মারধর করা হয় যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল।
“আমি কেবল বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছি। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমার গায়ের রঙের জন্যই এই ঘটনা ঘটেছে," দিয়ালো বলেন।
জার্মানিতে কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার মানেই হচ্ছে তাকে সবসময়ই বর্ণবাদের মুখোমুখি পড়তে হবে। দৈনন্দিন অপমান-অপদস্থ হওয়া থেকে শুরু করে মারাত্মক আক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে। পূর্ব জার্মানিতে এই ধরণের ঝুঁকি আরও বেশি হতে পারে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম জার্মানি একটি গণতান্ত্রিক, বৈচিত্র্যময় সমাজে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব জার্মানিতে ১৯৮৯ সালের শেষ পর্যন্ত একটি কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্র সরকার কায়েম ছিল। সেখানকার বাসিন্দাদের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সাথে খুব কমই যোগাযোগ ছিল এবং তাদের বহির্বিশ্বে অবাধে ভ্রমণের অনুমতি ছিল না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে থুরিঞ্জিয়ায় উগ্র ডানপন্থী শক্তিগুলো কৃষ্ণাঙ্গসহ সংখ্যালঘুদের জন্য বৈরী পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে।
এএফডির উত্থান
এখন, উগ্র ডানপন্থী দল, ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ বা এএফডির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ জার্মান এবং দিয়ালোর মতো আফ্রিকান অভিবাসীদের জন্য উদ্বেগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
থুরিঞ্জিয়ার জনসংখ্যা ২১ লক্ষ এবং ১ সেপ্টেম্বর সেখানে রাজ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চরম অভিবাসন বিরোধী এএফডি জনমত জরীপে ৩০ শতাংশ পেয়ে এগিয়ে আছে।
এজরা নামের এনজিও, যারা উগ্র-ডানপন্থীর হাতে যারা বর্ণবাদী এবং ইহুদী বিদ্বেষী সহিংসতার শিকার হয়েছেন তাদের সহায়তা করে, তারা ২০২৩ সালে থুরিঞ্জিয়ায় ৮৫ টি বর্ণবাদী আক্রমণ নথিভুক্ত করেছে। এই সংখ্যা ২০২২ সালে ৮৮ টি হামলার তুলনায় সামান্য কম যা এজরা ঐ রাজ্যে “ডানপন্থী এবং বর্ণবাদী সহিংসতা সর্বকালে সবচেয়ে বেশি” হিসাবে বর্ণনা করেছে।
“সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, থুরিঞ্জিয়ায় একটি চরম ডানপন্থী আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যা তার অনুসারীদের একটি লক্ষণীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরমপন্থি মতবাদে উদ্বুদ্ধ করতে অবদান রেখেছে। এজরা এবং বর্ণবাদ ট্র্যাক করা সংস্থাগুলির একটি দল তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছে, “এএফডি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি পার্টি প্রধান রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী করছে।”
থুরিঞ্জিয়ার এএফডি শাখাটি বিশেষত উগ্রপন্থী এবং চার বছর আগে এদেরকে “প্রমাণিত চরম ডানপন্থী” হিসাবে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।
থুরিঞ্জিয়ার অভিবাসন, বিচার ও ভোক্তা সুরক্ষা সম্পর্কিত মন্ত্রী ডোরিন ডেনস্টেড বলেন, “এখানে কর্তৃত্ববাদী শক্তি খুব শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তারা থুরিঞ্জিয়ার জন্য মারাত্মক ধরণের বিপদ ধারণ করছে।
জার্মানির অতীত
বর্তমানে জার্মানিতে কতজন কৃষ্ণাঙ্গ বাস করেন তার সঠিক সংখ্যা নথিভুক্ত নেই ৷ সরকারি পরিসংখ্যানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তথ্য নথিভুক্ত নেই৷ তবে ধারণা করা হচ্ছে, আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ১২ লক্ষ ৭০ হাজার৷ জার্মানিতে অভিবাসন ইস্যু পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান মেডিয়েনডিয়েনস্ট ইন্টিগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী এদের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের জন্ম জার্মানিতে।
জার্মানিতে বর্ণবৈষম্যের ইতিহাস ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে নাৎসিরা কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা করা, নির্বাসন দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা শুরু করার অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল ।
জার্মান সাম্রাজ্য ১৮৮৪ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত আফ্রিকায় অসংখ্য উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে বর্তমান তানজানিয়া, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, নামিবিয়া, ক্যামেরুন, টোগো এবং ঘানা অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জার্মান সরকার অতি সম্প্রতি ঐ সময়কালে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ফ্রেঙ্ক -ভাল্টার স্টাইনমায়ার ২০২১ সালে, ঔপনিবেশিক আমলের জার্মানদের নিষ্ঠুর অতীতের মুখোমুখি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং ২০২৩ সালে তিনি এক শতাব্দী আগে তানজানিয়ায় ঔপনিবেশিক যুগে যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল তার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন।
অজ্ঞতা থেকে বৈষম্য
ক্যামেরুনের ৫৮ বছর বয়সী রসায়নবিদ ড্যানিয়েল এগবে, যিনি ১৯৯৪ সালে পড়াশোনার জন্য থুরিঞ্জিয়ায় এসেছিলেন, তিনি বলেন, জার্মানরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসনামলের ইতিহাস সম্পর্কে যে অত্যন্ত কম জানেন তা দেখে তিনি হতবাক। তিনি বলেন, এই অজ্ঞতা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অসম আচরণের কারণও হতে পারে।
“আমি স্কুলে পড়াচ্ছি”, এগবে এপিকে বলেন, “ আমি তাদেরকে আমার নিজের সম্পর্কে কিছু বলি এবং বিশেষ করে এই সত্যটি যে ক্যামেরুন একসময় একটি জার্মান উপনিবেশ ছিল। অনেক শিক্ষার্থী আফ্রিকা বা জার্মানির অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং এটি মানচিত্রে থাকা উচিত।
এগবে ২০০৩ সালে জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করার পর এএমএএইচ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি পূর্ব থুরিঞ্জিয়ার ইয়েনা শহরে আফ্রিকা থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং অভিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হলে তাদের তারা সহায়তা করে।
তিনি এএফডির উত্থানে উদ্বিগ্ন কিন্তু সেখান থেকে চলে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা তার নেই।
“আমরা স্থান ত্যাগ করব না, আমরা এই সমাজকে পরিবর্তন করতে আমাদের ভূমিকা পালন করব," তিনি বলেছেন। “মানুষ যেটা বা যাকে জানেনা বাঁ চিনেনা, তারা বেশিরভাগ সময় সেটাই ভয় পায়। শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে