বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড পরিচালনা করা থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়া - জেয় শাহ'র বিস্ময়কর উত্থান ক্রিকেটের বৈশ্বিক প্রশাসনে ভারতের আধিপত্যকে দৃশ্যমান করেছে।
যে দেশে ক্রিকেট আর রাজনীতি এক সাথে চলে, সেখানে এমনকি ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই)-এর সর্বশক্তিমান সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ হবার পরও ৩৫-বছর বয়সী জে শাহ তার বাবার নামেই বেশি পরিচিত।
তার বাবা হচ্ছেন ভারতের ক্ষমতাবান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
এখন, বিসিসিআই-এর শীর্ষ পদ গ্রহণ করার পাঁচ বছর পর, জে শাহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রভাবশালী আইসিসি-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
আইসিসি'র শীর্ষ পদে তিনিই হবেন সবচেয়ে কনিষ্ঠ ব্যক্তি। এই কাজে তিনি এমন এক ক্রীড়ার তদারকি করবেন যার ১০০ কোটির বেশি ভক্ত আছে – যাদের ৯০ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে বাস করেন বলে ২০১৮ সালে করা আইসিসির এক গবেষণায় দেখা গেছে।
ক্রিকেটের অর্থনীতির উপর ভারতের প্রভাব শাহকে জয়ের জন্য শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি ইতোমধ্যেই আইসিসির আর্থিক এবং বাণিজ্যিক কমিটির প্রধান ছিলেন।
শাহ দুর্দান্ত জনপ্রিয় ইন্ডিয়ান প্রেমিয়ার লীগ (আইপিএল)-এর দ্রুত উত্থানের তদারকি করেছেন। সংক্ষিপ্ত টি-২০ ফরম্যাটের এই টুর্নামেন্টে মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ক্রিকেট তারকাদের আকৃষ্ট করা হয়।
এই পথ-দেখানো টুর্নামেন্ট আইপিএল ২০২২ সালে পাঁচ মৌসুমের জন্য সম্প্রচার স্বত্বাধিকার বিশ্বের মিডিয়ার কাছে চোখ-ধাঁধানো ৬২০ কোটি ডলারে বিক্রি করে। এর ফলে, প্রতি-ম্যাচের-জন্য-দামের হিসেবে আইপিএল বিশ্বের সবচেয়ে দামি স্পোর্টস লীগগুলোর কাতারে চলে আসে।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বিসিসিআই-কে অসাধারণ ক্ষমতাশালী করে তুলেছে, এবং সেখান থেকে প্রভাব আর সুবিধার জন্য শীর্ষ রাজনিতিকরা নিজ নিজ রাজ্যের ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে মরিয়া।
অলিম্পিকের স্বপ্ন
কিন্তু জে শাহ আরও বড় স্বপ্ন দেখছেন।
তিনি এশিয়া ক্রিকেট কাউন্সিলেরও প্রধান এবং অলিম্পিক গেমসের ক্রীড়ার তালিকায় ক্রিকেট ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।
তিনি বিশ্বব্যাপী ভারতীয় সমর্থকদের “অতুলনীয় বিস্তৃতির” কথা বলেছেন। ক্রিকেট ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকসের অংশ হতে যাচ্ছে এবং শাহ ক্রিকেট ব্যবহার করে ২০৩৬ সালের অলিম্পিকস ভারতে আয়োজন করার আশা বাড়াতে চাচ্ছেন।
“লস অ্যাঞ্জেলেসে ২০২৮ সালের অলিম্পিকসে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি এই ক্রীড়ার উন্নয়নের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত, এবং আমি নিশ্চিত এর ফলে ক্রিকেট নজিরবিহীন ভাবে এগিয়ে যাবে,” জে শাহ মঙ্গলবার নির্বাচিত হবার পর বলেন।
শাহ’র ক্যারিয়ার দ্রুত অগ্রসর হতে শুরু করে তার নিজস্ব রাজ্য গুজরাটে ২০০৯ সালে, তিনি যখন একজন তরুণ।
এর আগে তার বাবা নিজেও গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জে শাহ ২০১৩ সালে জিএসএ-র যৌথ সেক্রেটারির দায়িত্ব পান।
তার তত্ত্বাবধায়নে গুজরাটের প্রধান শহর আহমেদাবাদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়, ১৩২,০০০-আসন বিশিষ্ট ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পরিণত করার নির্মাণ কাজ শুরু হয়, পরে যে স্টেডিয়াম নরেন্দ্র মোদীর নামে নামকরণ করা হয়।
দু’বছর পর তিনি বিসিসিআই-এর উচ্চ মহলে যোগ দেন এবং ২০১৯ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে জাতীয় বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
দেশের ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে শীর্ষ চাকরিতে তার নিয়োগের ফলে অনেকে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার হন। প্রায় দের’শ কোটি মানুষের ক্রিকেট-পাগল দেশে, যেখানে ক্রিকেটকে খেলার চেয়ে ধর্ম হিসেবে দেখা হয় বেশি, সেখানে শাহ’র ভূমিকা খুব আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
তিনি বিসিসিআই-এ দায়িত্ব পালন করার সময় মিডিয়াতে সরাসরি সাক্ষাৎকার এড়িয়ে গেছেন। তবে শাহ নিজেকে একজন তরুণ, কর্মঠ প্রশাসক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজের এমন ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, যিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এবং প্লেয়ারদের সাহায্য করার জন্য সব সময় প্রস্তুত।
বছরের আগের দিকে, তিনি ক্রিকেটারদের ঘরোয়া ক্রিকেট অবহেলা করে আইপিএলকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেন।
“ঘরোয়া ক্রিকেট যে ভারতীয় ক্রিকেটের মেরুদণ্ড, এটার স্বীকৃতি দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” তিনি লেখেন। দেশের যেসব সুপারস্টার ক্রিকেটার আইপিএল-এর মত ফ্র্যাঞ্চাইজ টুর্নামেন্টের লোভে ঘরোয়া ক্রিকেট বাদ দিয়েছেন, তাদের দিকে লক্ষ্য করে এটা ছিল বিরল এক তিরস্কার।
নারী ক্রিকেটের সমর্থক
শাহ নিজেকে নারী ক্রিকেটের প্রচারক হিসেবে উপস্থাপন করেন, যখন ২০২৩ সালে বিসিসিআই আইপিএল-এর আদলে উইমেনস প্রেমিয়ার লীগ চালু করে।
ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে প্লেয়ার, কোচ এবং মাঠ কর্মীরা উন্নত বেতন এবং কন্ট্রাক্ট-এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন।
কিন্তু ভারতের কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমীর সুবিধা এবং খেলা উপভোগ করার অভিজ্ঞতা উন্নীত করার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ না নেয়ার জন্য শাহ’র অধীনে বিসিসিআই সমালোচনার মুখেও পড়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, বিসিসিআই-এর অঢেল পয়সা থাকার ফলে তারা আইসিসিতে কল-কাঠি নাড়াতে পারে।
আইসিসি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগে অন্যান্য দেশে জাতীয় বোর্ড সাসপেন্ড করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালে জিম্বাবুয়ে এবং গত বছর শ্রী লঙ্কা।
কিন্তু ভারতে ক্ষমতাসীন দল এবং ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আইসিসি কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
শাহ’র প্রচেষ্টার ফলে ২০২২ সালে বারমিংহামে কমনওয়েলথ গেমস এবং গুয়াংঝুতে ২০২২ সালের এশিয়ান গেমসে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
“তিনি ঠিক যা ভারতের ক্রিকেটের জন্য করেছেন, পুরুষ এবং নারী উভয়ের জন্য, বিশ্বব্যাপীও প্লেয়াররা সুফল পাবে,” ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তী সুনীল গাভাস্কার এই তরুণ প্রশাসক সম্পর্কে স্পোর্টস্টার প্রকাশনায় লেখেন।