অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

৭ অক্টোবরের হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারীকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল


ফাইল- গাজা ভূখন্ডের দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিসে ১৩ জুলাই, ২০২৪ ‘এ ইসরায়েলি বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত স্থান পরিদর্শন করছেন ফিলিস্তিনিরা। জানা গেছে সেই আক্রমণে হামাসের সামরিক বাহিনীর উইং কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ নিহত হন।
ফাইল- গাজা ভূখন্ডের দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিসে ১৩ জুলাই, ২০২৪ ‘এ ইসরায়েলি বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত স্থান পরিদর্শন করছেন ফিলিস্তিনিরা। জানা গেছে সেই আক্রমণে হামাসের সামরিক বাহিনীর উইং কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ নিহত হন।

ইসরায়েল বৃহস্পতিবার জানায় তারা হামাসের সামরিক বাহিনীর প্রধান মুহম্মদ দেইফকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে হত্যা করেছে। মনে করা হয় ৭ অক্টোবর গাজার দক্ষিণাঞ্চলের শহর খান ইউনিসে হামলা চালানোর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন এই ব্যক্তি।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়োভ গ্যাল্যান্ট দেইফকে “ গাজার ওসামা বিন লাদেন” বলে অভিহিত করেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আল-ক্বায়দার সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রধান হোতা ছিলেন বিন-লাদেন; ওই হামলায় প্রায় ৩,০০০ লোক প্রাণ হারান।

গ্যাল্যান্ট বলেন ১৩ জুলাই দেইফের হত্যা হচ্ছে “ গাজায় হামাসকে সামরিক ও শাসক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়ায় এবং এই যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক”।

এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলে যে গোয়েন্দার মূল্যায়নের ভিত্তিতে তারা মনে করে দেইফ মারা গেছেন তবে তারা বিস্তারিত আর কিছু জানায়নি । ইসরায়েল তাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় যাতে ৯০ জন নিহত হন তবে তার নিয়তিতে কি হয়েছে তা জানা যায়নি। হামাস তার মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার কিংবা অস্বীকার করেনি।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ১ আগস্ট ২০২৪ সালে এই ছবিটি প্রকাশ করে যেখানে হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ১ আগস্ট ২০২৪ সালে এই ছবিটি প্রকাশ করে যেখানে হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

গ্যাল্যান্ট বলেন জুলাই মাসের অভিযানটি ইসরায়েলর প্রতিরক্ষা বাহিনী ও নিরাপত্তা বিভাগ “ সুনির্দিষ্ট ভাবে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে । এই অভিযানে এই সত্যটাই বেরিয়ে আসে যে হামাস বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং হামাস সন্ত্রাসীরা হয় আত্মসমর্পণ করতে পারে নইলে তাদের নিশ্চিহ্ন করা হতে পারে”।

দেইফ তাকে হত্যা করার বহু ইসরায়েলি প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। ২০১৪ সালে ইসরায়েল তার বাড়িতে বোমা ফেললে তার স্ত্রী ও শিশুপুত্র প্রাণ হারায়।

গত অক্টোবরে ইসরায়েলের উপর হামলা শুরু হলে, দায়েফ রেকর্ডে ধারণ করা তার একটি ভাষণ প্রচার করে যাতে বলা হয়েছে হামাস এই অভিযান শুরু করেছে যাতে “শত্রু বুঝতে পারবে যে জবাবদিহিতাবিহীন তাদের অসংযত আচরণের সময় শেষ”।

হামাসের আল আকসা টিভিতে তিনি ইসরাইলকে উল্লেখ করে বলেন, “ এই অপরাধী শত্রুকে শেষ করার জন্য এটা হচ্ছে তোমাদের দিন , হে ন্যায়নিষ্ঠ যোদ্ধারা । তাদের সময় শেষ। তাদের যেখানেই পাও, হত্যা করো..... তোমাদের ভূমি থেকে এবং তোমাদের পবিত্র স্থানগুলি থেকে এই আবর্জনা সরিয়ে ফেলো। লড়াই করো আর ফেরেশতারাও তোমাদের সঙ্গে লড়াই করবে”।

দেইফের মৃত্যু হচ্ছে তিনটি দেশে ইসরায়েল বিরোধী জঙ্গি হত্যার তৃতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

গত মঙ্গলবার বৈরুতে হেজবুল্লাহর একটি ভবনে ইসরায়েলি বিমান আক্রমণে হেজবুল্লাহ কমান্ডার ফুয়াদ শুকুর নিহত হন। ইসরায়েল বলছে গোলান হাইটস’এ একটি ফুটবল মাঠে গত সপ্তাহান্তে একটি বিমান হামলার জন্য শুকুর দায়ী যাতে ১২ জন শিশু ও কিশোর নিহত হয়। এর কয়েক ঘন্টা পরেই হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েকে তেহরানে হত্যা করা হয়।

প্রথমে মনে করা হয়েছিল ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানের পর হানিয়ে যে ভবনে ছিলেন সেখানেই বিমান হামলায় তিনি মারা যান। তবে বৃহস্পতিবার দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায় যে মধ্য প্রাচ্য ও আমেরিকার বহু কর্মকর্তা সংবাদপত্রটিকে জানায় যে দূর-নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরকের আঘাতে হানিয়ে নিহত হন। ওই বিস্ফোরক যন্ত্রটি দু মাস আগে গোপনে তেহরানের একটি অতিথিশালায় রাখা হয় , যেখানে তেহরান সফরের সময়ে তিনি প্রায়ই থাকতেন।

ইসরায়েল হানিয়েকে হত্যার কথাটি প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি কিন্ত সংবাদপত্রটি বলছে যে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এই অভিযান এবং বিস্ফোরণের পরিণতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমি সরকারদের অভিহিত করেছে।

বৃহস্পতিবার এক ভাষণে হেজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ বলেন, “ ইসরায়েলিরা আনন্দিত;তারা সাইয়েদ মহসিন(ফুয়াদ শুকুর) ও ইসমাইল হানিয়েকে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে হত্যা করেছে। এখন হেসে নাও, কিন্তু পরে তোমরা অঝোরে কাঁদবে”।

নাসরাল্লাহ বলেন, “তোমরা জানোনা তোমরা কি রকম বিপদ রেখা অতিক্রম করেছো। শত্রুকে এখন উষ্মা ও পাল্টা ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে । আমরা সকল ফ্রন্টেই একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করেছি”।

শুকুর ও হানিয়ে উভয়ের জানাজার নামাজ বৃহস্পতিবার পড়ানো হয় এবং ইরান ও হেজবুল্লাহ এই হত্যার ব্যাপারে কি ধরণের সাড়া দিবে সে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

তেহরানে হানিয়ের জানাজার নামাজ পড়ানো হয় যাতে ইমামতি করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। সাধারণত এই সম্মানটি পেয়ে থাকেন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা। নিউ ইয়র্ক টাইমস তিনজন ইরানি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায় যে হানিয়ে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে খামেনি ইসরায়েলের উপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। ওই ইরানি কর্মকর্তাদের পরিচয় জানানো হয়নি।

হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ে ও তার দেহরক্ষীর জানাজার পর মরদেহ বহনকারী একটি ট্রাকের পেছনে ইরানিরা মিছিল করে যাচ্ছে । তেহরান, ইরান, ১ আগস্ট ২০২৪।
হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ে ও তার দেহরক্ষীর জানাজার পর মরদেহ বহনকারী একটি ট্রাকের পেছনে ইরানিরা মিছিল করে যাচ্ছে । তেহরান, ইরান, ১ আগস্ট ২০২৪।

ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানও জানাজার নামাজে অংশ নেন এবং হাজার হাজার ইরানি রাস্তায় মিছিল করে যায়।

বৃহস্পতিবার মঙ্গোলিয়া সফরের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন হানিয়ে হত্যার ব্যাপালে সরাসরি কোন মন্তব্য করেননি তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির আহ্বান জানান।

ব্লিংকেন বলেন , “ এখন ওই অঞ্চলটি আরও সংঘাত, আরও সহিংসতা , আরও দূর্ভোগ এবং আরও নিরাপত্তাহীনতার পথে রয়েছে তাই এটা খুব জরুরি যে আমরা এই চক্রটি ভেঙ্গে ফেলি এবং আমরা যা নিয়ে কাজ করছি সেই অস্ত্রবিরতি দিয়ে শুরু করি যা কীনা আমি বিশ্বাস করি কেবল অর্জন করা সম্ভব নয়, অর্জন করতেই হবে”।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বুধবার সতর্ক করে দেন যে হানিয়ের হত্যা এবং বৈরুতে শুকুরকে ইসরায়েলের হত্যাা করা ওই অঞ্চলে উত্তেজনার “ বিপজ্জনক বৃদ্ধিকেই তুলে ধরে”।

এক বিবৃতিতে গুতেরেস বলেন, যে সময়ে ১০ মাস ব্যাপী ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে অস্ত্র বিরতিতে পৌঁছানোর এবং দূর্ভিক্ষের কবলে পড়া ফিলিস্তিনদের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির ব্যাপারে “ সকল প্রচেষ্টার” গুরুত্ব দেওয়ার কথা, তার পরিবর্তে “ আমরা যা দেখছি তা হলো এই সব লক্ষ্যকে খর্ব করার প্রচেষ্টা”।

বুধবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতেনিয়াহু বলেন যে এই ইহুদি রাষ্ট্রটি “ যে কোন ক্ষেত্রে আমাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের চড়া মূল্য আদায় করে নিবে” কিন্তু তিনি হানিয়েকে হত্যা করার কথা উল্লেখ করেননি।

ইরান সমর্থিত হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ১২০০ লোককে হত্যা এবং প্রায় ২৫০ জনকে পণবন্দি করার প্রায় দশ মাস পর হানিয়ে হত্যার ঘটনাটি ঘটলো।

ও দিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের মতে গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণে ৩৯,৪০০ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান তবে ইসরায়েল বলছে মৃতদের এই সংখ্যার মধ্যে হাজার হাজার হামাস যোদ্ধাও রয়েছে যাদেরকে তারা হত্যা করেছে।

কয়েক মাস ধরে কাতার, মিশর এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে অস্ত্র বিরতির মধ্যস্ততা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে, তবে হানিয়ের হত্যার পর সেই প্রক্রিয়া গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ য়ে পড়ে।

ইসরায়েলি বাহিনী বৃহস্পতিবারও খান ইউনিসে বিমান হামলা এবং রাফাহ ও গাজার মধ্যাঞ্চলে স্থল অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে তাদের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে।

এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছে ভয়েস অফ আমেরিকার ফার্সি বিভাগ। কিছু তথ্য এসেছে এপি, এএফপি ও রয়টার্স থেকে।

XS
SM
MD
LG