পুতিন প্রায়ই বলেন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ‘পারমাণবিক মতবাদ’ দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি কি রকম?
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর থেকে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ক্রেমলিনের অন্যান্যরা প্রায়শই পশ্চিমকে হুমকি দিয়ে আসছেন তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার নিয়ে।
যুদ্ধের একেবারে প্রথম দিনই পুতিন বলেন, “ আমাদের জন্য যদি কেউ প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করে , আমাদের দেশ ও আমাদের জনগণকে হুমকি দেয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম, তাদের জানা উচিৎ যে রাশিয়া তাৎক্ষণিক ভাবে ‘এর জবাব দিবে এবং তাতে এমন পরিণতি হবে যা আপনারা ইতিহাসে কখনই দেখেননি”।
গত আড়াই বছর ধরে চলমান এই লড়াইয়ে, ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র দিয়েছে পশ্চিম, কোন কোন অস্ত্র রাশিয়ার মাটিতেও আঘাত হেনেছে । আর এরই মধ্যে যদিও ক্রেমলিন থেকে আরও হুমকি এসেছে এবং এমনকী ইউক্রেনের সীমান্তের কাছেই বেলারুশে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য পরমাণু অস্ত্র রাশিয়া মোতায়েন করেছে – এ পর্যন্ত এটা কেবল কথার কথা হয়ে থেকেছে ।
তা হলে শেষ পর্যন্ত কি ভাবে রাশিয়া পারমাণবিক জবাব দিবে ?
জুন মাসে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির এই প্রশ্নের জবাবে পুতিন রাশিয়ার কথিত পারমাণবিক মতবাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেন্ট পিটার্সবার্গ অধিবেশনে তিনি বলেন, “ দেখুন কি লেখা আছে সেখানে। কারও কর্মকান্ড যদি আমাদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি হয়ে ওঠে তখন আমরা আমাদের আয়ত্বে থাকা সব কিছু ব্যবহার করার সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখবো”।
এখন রাশিয়ার যুদ্ধবাজরা পুতিনকে বলছেন যে পারমাণবিক অস্ত্রব্যবহারের সীমা নামিয়ে আনার জন্য তিনি যেন তাঁর মতবাদে পরিবর্তন আনেন, আর পুতিন বলছেন পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ঐ নথি সংশোধন করা যেতে পারে।
রাশিয়ার পারমাণবিক মতবাদ তা হলে কি ?
আগে এটি, “পরমাণু প্রতিরোধের রাষ্ট্রীয় নীতির মূল তত্ত্ব” নামে পরিচিত ছিল যা কীনা ২০২০ সালে পুতিন স্বাক্ষর করেন এবং তাতে লেখা আছে রাশিয়া ঠিক কখন আণবিক অস্ত্রভান্ডার ব্যবহার করতে পারবে । তাদের অস্ত্রভান্ডার হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্রভান্ডার।
এতে পরমাণু অস্ত্রকে” প্রতিরোধের উপায়” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে এই অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, “ চরম ও বাধ্যতামূলক” পদক্ষেপ। এতে ঘোষণা করা হয়েছে “ পারমাণবিক হুমকি হ্রাস করতে এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের এমন অবনতি রোধ করতে যা পারমানবিক সংঘাতসহ সামরিক সংঘের্ষর সুত্রপাত ঘটাতে পারে সব প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালাবে” রাশিয়া।
ওই নথিতে বলা হয়েছে যে, “ পারমাণবিক প্রতিরোধের লক্ষ্য হচ্ছে রুশ ফেডারেশন এবং/অথবা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের ঘটনায় অবশ্যম্ভাবী পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাব্য বৈরিপক্ষকে সামগ্রিক বিষয়টি জানানো”।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কখন দেখা দেবে , এ সম্পর্কে এই মতবাদে কি বলা হয়েছে?
এই মতবাদটিতে বলা হয়েছে রাশিয়া এগুলি ব্যবহার করতে পারে, “ তার এবং/ অথবা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বা অন্য ধরণের ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহারে এবং প্রথাগত অস্ত্র ব্যবহার করে রুশ ফেডারেশনের বিরুদ্ধে এমন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে”।
এতে বলা হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে:
— যদি রাশিয়া কিংবা তার মিত্রদের লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়।
— যদি রাশিয়া কিংবা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
— যদি প্রথাগত অস্ত্র দিয়ে শত্রুর আক্রমণ রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।
— যদি রুশ সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান কিংবা সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালানো হয় যা দেশটির পাল্টা পারমাণবিক আক্রমণের ক্ষমতাকে খর্ব করে।
এই মতবাদে কি ধরণের পরিবর্তন আলোচনায় আসছে ?
সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোর সাফল্যের কারণে ক্রেমিলনের পারমাণবিক হুমকি কমে এসেছে। তবে রাশিয়ার ভেতরেই এই পারমাণবিক মতবাদ পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হচ্ছে এবং পুতিন বলছেন বৈশ্বিক ঘটনাবলির উপর নির্ভর করে এতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
রাশিয়ার যুদ্ধবাজরা এই নিয়ম আরও কঠোর করার জন্য বার বার আহ্বান জানাচ্ছে । তাদের যুক্তি হলো বর্তমান তত্বটি খুব দূর্বল ও অস্পষ্ট। তিনি বলেন এই মতবাদ ইউক্রেনের সাহায্য বাড়ানো থেকে পশ্চিমকে প্রতিহত করতে পারেনি এবং এমন ধারণা দিয়েছে যে মস্কো কখনই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না।
মস্কোর রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত একটি চিন্তক গোষ্ঠী ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ইকনমি এন্ড ইন্টারন্যশানাল রিলেশনস’এর পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দ্যমিত্রি ত্রেনিনের পরামর্শ হলো এতে পরিবর্তন আনা যাতে এমন ঘোষণা করা যায় যে যদি রাশিয়ার “ মূল স্বার্থ বিপদের মুখে পড়ে”,যেমনটি ইউক্রেন যুদ্ধের সময় তা হলে রাশিয়াই পরমাণু অস্ত্র দিয়ে প্রথমে আঘাত হানতে পারে”।
ত্রেনিন সম্প্রতি লেখেন, “ সামরিক সংঘাতের এই তৃতীয় বছরে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে এতে নেটোর গভীর সম্পৃক্ততায় বাধা দেওয়া। যদি আমরা সেটা না করি তা হলে পশ্চিমের চলমান যুদ্ধ বৃদ্ধির মুখে আমাদের এই স্থবিরতা শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ও নেটোর সামরিক বাহিনীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বাঁধাতে পারে যা কীনা বিশ্বব্যাপী অনাকাঙ্খিত পরমাণু যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারে”।
সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে, ক্রেমলিনের উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ সার্গেই কারাগানভও পুতিনকে এই মতবাদে পরিবর্তন এনে , পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের শর্তকে আরও কমিয়ে আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি রুশ এই নেতাকে বলেন, “ আমি আশা করি এটা শীঘ্রই পরিবর্তন করা হবে যাতে আমাদের দেশে যে কোন আক্রমণের জবাবে আপনি পারমাণবিক আক্রমণ চালাতে পারেন। আমি আশা করি যে এই বিধানটি আমাদের এই তত্বে যোগ করা হবে যা আমাদের প্রতিপক্ষদের শান্ত করতে সাহায্য করবে”।
কারাগানভ পশ্চিমকে সোদোম ও গোমোরাহ নামের বাইবেলের দু’টি শহরের সঙ্গে তূলনা করেন যে শহরগুলিকে তাদের মন্দ কাজের জন্য ঈশ্বর অগ্নিবৃষ্টি নামিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। তিনি বলেন, “ আমাদের সেই বৃষ্টির কথা স্মরণ করতে হবে এবং মানব সমাজের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হোক”।
পুতিন সতর্কতার সঙ্গে জবাব দেন এই বলে যে তিনি বর্তমানে একান রকম হুমকি দেখছেন না যাতে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে। তবে তিনি এই নীতি পূনর্বিবেচনার দ্বারও খোলা রেখেছেন।
তিনি বলেন, “ এই মতবাদ একটি চলমান উপায়, আমরা সতর্কতার সঙ্গেই দেখছি আমাদের চারিদিকের বিশ্বে কি হচ্ছে এবং আমরা আমাদের এই মতবাদে পরিবর্তন আনার বিষয়টি বাদ দিচ্ছি না”।
তিনি বলেন পশ্চিম অল্প ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের সম্ভাব্যতা নিয়ে যখন ভাবছে তখন সে নিয়ে উদ্বেগের কারণে এই নথিতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পুতিন সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলেননি কিন্তু তার মন্তব্য হয়ত ডুবো জাহাজে স্বল্প শক্তি সম্পন্ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার প্রেক্ষাপটে আসতে পারে।
প্রস্তাবকরা বলছেন রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলা করার জন্য এ ধরণের অস্ত্রের প্রয়োজন রয়েছে তবে সমালোচকরা বলছেন এতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সীমা আরও কমে আসতে পারে এবং যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
পুতিন বলেন, “ অত্যন্ত স্বল্প ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে এবং পশ্চিমের বিশেষজ্ঞ মহলে যে ধারণাগুলি প্রচার করা হচ্ছে যে আঘাত হানতে সক্ষম এ অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে তবে এতে বিশেষ করে মারাত্মক তেমন কিছু নেই। আমরা এ ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে দায়বদ্ধ এবং আমরা তাই করছি”।