দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে সশস্ত্র সংঘাতের উপর নরজদারি করে এমন একটি গোষ্ঠী এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে বলছে যে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে লড়াই যেমন তীব্র হচ্ছে তেমনি স্কুলগুলিতে ধ্বংসাত্মক হামলা অনেক বেড়ে গেছে।
মিয়ানমার উইটনেস নামের এই গোষ্ঠীটি বলছে যে এই ধরণের আক্রমণ মিয়ানমারের ভঙ্গুর স্কুল ব্যবস্থাকে আরও সংকটে ফেলেছে যেখানে লক্ষ লক্ষ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । তারা ঘর-বাড়ি ছেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, টীকা নেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অপর্যাপ্ত পুষ্টির শিকার হয়েছে।
ব্রিটেন ভিত্তিক সেন্টার ফর ইনফরমেশান রেসিলেলিয়েন্সের প্রকল্প এই গোষ্ঠীটি তিন বছর আগে অন সান সুচি’র নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মোট ১৭৪ বার আক্রমণ হয়েছে। তারা বলেছে সামাজিক মিডিয়া ও সংবাদ প্রতিবেদন থেকে এই হিসেব গণনা করা হয়েছে।
অন্যান্য গোষ্ঠী ও বলছে আক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠী, দ্য গ্লোবাল কোয়ালিশন টু প্রোটেক্ট এডুকেশান স্কুলগুলিতে ২৪৫টি আক্রমণের রিপোর্ট দিয়েছে এবং ২০২২-২৩ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের ১৯০ টি প্রতিবেদন তুলে ধরেছে।
২০২১ সালের সামরিক অভুত্থানের বিরুদ্ধে , গণতন্ত্রের পক্ষে ব্যাপক ভাবে অহিংস বিক্ষোভ হয়েছিল কিন্তু সেগুলোকে মারনাঘাত করে দমন করা হয়। তখন সামরিক শাসনের বিরোধী অনেকেই হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, দেশটির একটি বড় অংশ এখন সংঘাতের সম্মুখীন। এক হিসেবে বলা হচ্ছে সামরিক সরকার দেশের অর্ধেকেরও কম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।
মিয়ানমার উইটনেসের প্রকল্প পরিচালক ম্যাট লরেন্স বলেন, “ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা কিন্তু আজ মিয়ানমারের তরুণরা দেখছে তাদের স্কুল-তাদের জীবনের সুযোগ- ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে শিক্ষাকে যদি রক্ষা করা না যায়, পৃথিবীকে নিয়ে আগামি প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি আশা ও যুক্তির পরিবর্তে বিভাজন ও যুদ্ধ দ্বারা পরিচালিত হবে”।
মানবিক গোষ্ঠী সেইভ দ্য চিল্ড্রেনের মতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরে , কভিড-১৯ শুরু হ্ওয়ার সময় ২০২০-২০২২ সালে মিয়ানমারে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৮০% কমে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি নাগাদ দেশের প্রায় অর্ধেক শিশুই মানে ৭৮ লক্ষ শিশু আর স্কুলে যাচ্ছিল না।
মিয়ানমার উইটনেস বলেছে স্কুলগুলিতে ১৭৬টি আক্রমণের ঘটনায় তারা ৬৪টি হত্যা এবং ১০৬টি জখম হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেছে যদিও অধিকাংশটি যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।
মিয়ানমারে ন্যাশনাল ইউনিটির ছায়া সরকার, যারা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে জানুয়ারিতে দেওয়া হিসেবে জানিয়েছে যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী ১৮ বছরের কম বয়সী ৫৭০ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করেছে।
মিয়ানমার উইটনেস অধিকাংশ স্কুলগুলি ধ্বংস করার জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনীর বিমান হামলাকে দায়ী করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে গণতন্ত্রপন্থি বাহিনী ও জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক জায়গা দখল করতে সমর্থ হয়।
লরেন্স দ্য এসেসিয়েটেড প্রেসকে বলেন সামরিক বাহিনী “ আরও বেশি করে বিমান আক্রমণ শুরু করে যখন তারা স্থলক্ষেত্রে কার্যকর কিছু অর্জন করতে পারে না” কারণ তার প্রতিরোধকারীদের আক্রমণের সম্মুখীন হয়।
সামরিক বাহিনী অসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু করার কিংবা বিশাল বাহিনী ব্যবহার করার বিষয়টি বার বার অস্বীকার করে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রতিরোধ বাহিনীও স্কুলগুলিতে আক্রমণ চালিয়েছে তবে অতটা ঘন ঘন নয় এবং ধ্বংসাত্মক ভাবেও নয়।
শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে আরও কিছু কারণে। অনেক তরুণ, বয়সী শিক্ষার্থী, প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর হাজার হাজার শিক্ষক তাঁদের কাজ ছেড়ে আইন অমান্য করার অসামরিক আন্দোলনে যোগ দেন যার লক্ষ্য ছিল সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিতে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অচল করে দেওয়া। আর সংঘাতের স্থান পরিবর্তনের কারণে শিক্ষকদের বিশ্বাসযোগ্যভাবে শিক্ষাদানও ব্যাহত হয়।
কোন কোন শিক্ষক সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিংবা তেমন স্কুলে যোগ দিয়েছেন।
যথার্থ শিক্ষার নাগাল না পাওয়াটা মিয়ানমারের ক্রমশই বৃদ্ধি পাওয়া মানবিক সংকটের একটা দিক মাত্র। লড়াইয়ের কারণে ৩০ লক্ষেরও বেশি লোক গৃহচ্যূত হয়েছেন, অধিকাংশই হয়েছেন ২০২১ সালে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর। তা ছাড়া ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটতো রয়েছেই।
বিশ্বে শিশুদের খাদ্য দারিদ্র বিষয়ক জাতিসংঘের শিশু তহবিলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিয়ানমারের শিশুদের ৩৫% শতাংশই খাদ্যভাবের সম্মুখীন ।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর মতে মিয়ানমারের শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি এখন দারিদ্র সীমার নীচে বাস করছে আর দেশটির মধ্যব্ত্তিরা এখন বিলুপ্ত প্রায়।