বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলাকালে রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে ১ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, এ ঘটনায় দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা ১১টায় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। বিকেল ৪টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশপাশের অলি-গলিতে সংঘর্ষ চলছিল।
সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির নাম ইয়ামিন (২৪)। তিনি মিরপুরের এমএসআইটির শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজা এলাকায় জড়ো হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেয় শত শত শিক্ষার্থী। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম রাজীবের নেতৃত্বে শান্তির পক্ষে স্লোগান নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী-সমর্থকরা পাকিজা এলাকায় উপস্থিত হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
ঘটনার এক পর্যায়ে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রসহ ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে।
এক ভিডিওতে দেখা গেছে, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আধুনিক অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছেন। দুপুর ২টার দিকে বাসস্ট্যান্ডের মনসুর মার্কেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকজন সড়কে লুটিয়ে পড়েন। তাদের নিকটস্থ সুপার প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা ইয়ামিনকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান জানান, নিহতের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।
এসময় পুলিশ দুই শতাধিক টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। পুলিশের ছোড়া এসব টিয়ার শেল ও রাবার বুলেটের আঘাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিভিন্ন অলি-গলিতে থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল। এ ঘটনায় মহল্লা বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অচল রাজধানী ঢাকা, বিভিন্ন স্থানে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ
এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলাকালে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দাঙ্গা পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ঢাকার বাড্ডা, মেরুল, উত্তরা, ধানমন্ডি, মতিঝিল ও আরামবাগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষকালে পুলিশকে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে দেখা গেছে।
পুলিশ ও বিজিবির সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি উপেক্ষা করে বাড্ডা ও এর আশপাশের এলাকায় রাস্তায় নেমে আসে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও এর কাছাকাছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা।
উত্তরায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করলে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আবাসিক এলাকাগুলোর অলি-গলিতে ছড়িয়ে যেতে থাকে। অলি-গলিতে সংঘর্ষে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা।
শাটডাউনের সকালে রাজধানীর চিরচেনা যান চলাচল ছিল না। প্রায় ফাঁকা রাস্তায় কয়েকটি বিআরটিসির দ্বিতল বাস চলতে দেখা যায়। গণপরিবহনের অনুপস্থিতিতে রাজপথ ছিল রিকশার দখলে। কোনো গণপরিবহন না থাকায় হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে অনেককে।
এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভাষণে কোটা প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের রায় না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানান। রায় নিয়ে তারা হতাশ হবে না বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া, আন্দোলন চলাকালে হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরপরই শাটডাউনের ডাক দেয় শিক্ষার্থীরা।
মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল বন্ধ
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মিরপুর-১০ নম্বরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুপুরে মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে মতিঝিল থেকে আগারগাঁও এবং মিরপুর ১১ থেকে উত্তরা উত্তর পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল।
মেট্রোরেলের পরিচালক (অপারেশন) মো. নাসির উদ্দিন জানান, দুপুরে গোলচত্বরে একটি পুলিশ বক্সে আগুন দিলে পরিস্থিতি বিবেচনায় দুপুর ২টায় আঁগারগাঁও–মিরপুর ১০ অংশে মেট্রো চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কোটা আন্দোলনকারী সন্দেহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীকে আটক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সামনে থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী সন্দেহে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুর আনুমানিক ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে থেকে তাদেরকে আটক করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ থাকায় ক্যাম্পাসের সামনে আগে থেকেই পুলিশের কড়া অবস্থান ছিল। সকাল থেকেই মানুষজন জড়ো হলে সরিয়ে দিচ্ছিল পুলিশ।
পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জবির প্রধান ফটকের সামনে থেকে প্রথমে একজন ও পরে আরও দুই শিক্ষার্থীকে সন্দেহভাজন হিসেবে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ।
আটক শিক্ষার্থীরা হলেন- কম্পিউটার সায়েন্সের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের মো. অপূর্ব কর্মকার ও সহপাঠী খন্দকার জালাল এবং সমাজকর্ম বিভাগের ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. ছাব্বির।
শিক্ষার্থীদের আটকের বিষয়টি স্বীকার করেছে পুলিশ। কোতোয়ালি থানার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হাসান মাতবর জানান, “ক্যাম্পাস বন্ধ থাকার পরও তারা ক্যাম্পাসের আশেপাশে সন্দেহজনকভাবে ঘুরাফেরা করছিল। তাদের মোবাইলে আন্দোলনের ছবি পাওয়া গেছে। যাচাই বাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমার সঙ্গে থানায় কথা হয়েছে। মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেবে পুলিশ। সহকারী প্রক্টরকে থানায় পাঠানো হয়েছে।