কোটা সংস্কারের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতকে পাশ কাটিয়ে সরকার কিছুই করবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি একথা জানান। বলেন, “কোটার বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দেবে সরকার সেটা বিবেচনা করবে, সেটার প্রতিপালন করার চেষ্টা করবে।”
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করেন। এরপর সাত থেকে আট জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে মামলা করেন। এখন যারা কোটা আন্দোলন করছেন, তারা তো হাইকোর্টে যাননি। হঠাৎ একদিন যখন হাইকোর্টের রায়ের কথা পত্রিকায় বের হয়েছে, তখন তারা আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। তারা হাইকোর্টে না গিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন;” যোগ করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আনিসুল বলেন, প্রশ্ন উঠেছে, কোটা আদালতের বিষয় নয়, সরকারের বিষয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আদালতে যখন একটি বিষয় যায়, তখন সরকার অপেক্ষা করে আদালত কী বলে। তারপর সরকার পদক্ষেপ নেয়। তাই, কোটার বিষয়ে সরকার আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। সরকার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আইনমন্ত্রী আরো বলেন, স্বততঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীরা চাইলে, আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারেন। আদালত মূল দরখাস্ত বিবেচনা, নিষ্পত্তিকালে তাদের বক্তব্য বিবেচনায় নেবেন। সর্বোচ্চ আদালত তাদের এ আশ্বাস পর্যন্ত দিয়েছেন। তারপরও এ আন্দোলন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে; প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি আরো প্রশ্ন করেন, “আন্দোলনে যে স্লোগান দেয়া হচ্ছে, এর প্রয়োজনীয়তা থাকে?”
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “ইনডেমনিটি আইন-এর ধারাবাহিকতায় আমরা কিন্তু এখন ছাত্রদের মুখে স্লোগানের কথা শুনছি। যারা আন্দোলন করছে, তারা যদি ‘আমি কে, তুমি কে, আমরা বাঙালি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ বলতেন তাহলে আমি অবশ্যই বলতাম, তারা সঠিক পথে আছেন।”
আনিসুল হক আরো বলেন যে যৌক্তিক কথা প্রধানমন্ত্রী শুনবেন। জনগণের জন্য যা ভালো হয়, তা প্রধানমন্ত্রী করবেন, কিন্তু তার সরকার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না। সেই আদর্শ হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ।
কোটা পুনর্বহাল প্রসঙ্গে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধাসহ বিদ্যমান কোটা বাতিল সংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রবিবার (১৪ জুলাই) বিকেলে ২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সরকার যদি বিদ্যমান কোটার হার পরিবর্তন করতে, কমাতে অথবা বাড়াতে চায়, তাহলে এই রায় বাধা হবে না।
এর আগে, গত ১১ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা ও আদেশ (অপারেটিভ অংশ) সম্বলিত এক পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করা হয়।
আইনজীবীরা বলছেন, আপিল বিভাগ গত ১০ জুলাই কোটার বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে আগামী ৭ আগস্ট শুনানির দিন রেখেছে আপিল বিভাগ। ফলে আপাতত হাইকোর্টের রায় কার্যকর হবে না।
কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ও আইনগত কোনো ভিত্তি নেই বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে করা ২৩৫ নম্বর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া রায় ও আদেশ এবং যে রায়টি ২০৬২/২০১৩ নম্বর লিভ টু আপিলের মাধ্যমে সংশোধিত আকারে আপিল বিভাগে বহাল রাখা হয়েছে, সেই রায়ের আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিদের কোটা পুনরায় বহাল করার নির্দেশ দেয়া হলো।
একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং অন্যান্য যদি থাকে, সেক্ষেত্রে কোটা বহাল রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব, সেটা আদেশের কপি গ্রহণের সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করার নির্দেশ দেয়া হলো।
রায়ে আরো বলা হয়, যেভাবেই হোক, যদি সব ক্ষেত্রে কোটার হার পরিবর্তন করতে, কমাতে অথবা বাড়াতে চায়, তাহলে বিবাদীদের (সরকারের) জন্য এই রায় ও নির্দেশনা বাধা হবে না। যদি কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটা পূরণ না হয়, সেক্ষেত্রে শূন্য পদ সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করার ক্ষেত্রে বিবাদীদের স্বাধীনতা থাকবে।
রায়ের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান বলেন, আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে। আগামী ৭ আগস্ট শুনানির দিন রেখেছে আপিল বিভাগ। ফলে আপাতত হাইকোর্টের রায় কার্যকর হবে না।
হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, রায়ে সব কোটা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। তবে, প্রয়োজনে সরকার তা কমাতে বা বাড়াতে পারবে। আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে। ফলে এ রায় এখনই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ ভাগ কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকারি পরিপত্র জারি করা হয়।
এই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাত ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেন। এরপর রুলের শুনানি শেষে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। রবিবার (১৪ জুলই) এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
কোটা পদ্ধতি প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ
এদিকে, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের চলমান ‘বাংলা ব্লকেডের’ মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের ওপর ৪ সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ।
বুধবার (১০ জুলাই) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির বেঞ্চ কোটা সংস্কার নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থীর করা আবেদনের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম জানান, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ৪ সপ্তাহের মধ্যে লিভ-টু-আপিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়েছে।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আপিল বিভাগে আবেদন করেন ২ জন কোটা আন্দোলনকারী। বুধবার (১০ জুলাই) আপিল বিভাগ এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করে চেম্বার আদালত।
এর আগে ৪ জুলাই রিট আবেদনকারীর আইনজীবী অনুপস্থিত থাকায় হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি মুলতবি করে আপিল বিভাগ।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে এ বছরের ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। রিট আবেদনকারী পক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন আপিল বিভাগ নট টুডে (৪ জুলাই নয়) বলে আদেশ দেয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়।
এ অবস্থায় কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী ৯ জুলাই আবেদন করেন। দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য ১০ জুলাই আপিল বিভাগে ওঠে। শুনানি শেষে স্থিতাবস্থার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।