ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গত বছর অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাসের প্রাণঘাতী হামলার জবাব দিতে একাধিক ভ্রান্তির কথা স্বীকার করল, যার মধ্যে রয়েছে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব ও অব্যবস্থা। গাজা যুদ্বের সূচনা পর্বের এই হামলায় নিজেদের ব্যর্থতা সম্পর্কে তদন্তের প্রথম ফলাফল তারা প্রকাশ করলো।
এই প্রতিবেদনে সীমান্তবর্তী বেঈরি সম্প্রদায়ের উপর আলোকপাত করা হয় যেখানে শতাধিক লোক নিহত হন এবং আরও ৩০ জনকে হামাস জিম্মি করে নিয়ে যায়। সে দিন সেই ভোর বেলার আক্রমণে এটি ছিল সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত একটি সম্প্রদায় এবং ৭ অক্টোবরের সংঘাতের এটি ছিল সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। এখানেই এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং জঙ্গিরা একদল জিম্মিকে একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখে। সামরিক বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র, রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে বলেন, “ কিব্বুতস বেঈরির অধিবাসীদের রক্ষা করতে সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয় । এটা বলা আমার জন্য কঠিন এবং কষ্টের কথা”।
ওই অচলাবস্থার সময়ে একটি ট্যাংক বাড়িটির উপর আঘাত করে এবং এতে এই উদ্বেগ বেড়ে যায় যে ১৩ জন পণবন্দি নিজেদের পক্ষের গুলিতে নিহত হয়েছেন। সামরিক বাহিনী এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে সম্ভবত তারা হামাস জঙ্গিদের দ্বারাই নিহত হয়, ইসরায়েলি গোলার আঘাতে নয় যদিও এটা পরিস্কার নয় যে তারা কি ভাবে এই উপসংহারে পৌঁছাল। ওই প্রতিবেদনে আরও পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। সেনাবাহিনী বলছে কিবুতস’এ ৩৪০ জন হামাস যোদ্ধা হামলা চালায়।
তদন্তকারীরা, তথ্য এবং তাদের নিজেদের জানা মতে এটাই নির্ধারণ করেছেন যে ট্যাংকের গোলায় ভবনটির ভেতরে কোন অসামরিক ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হননি”। তবে তারা বলছেন যে ভবনটির বাইরে দু জন ইসরায়েলি অসামরিক লোকের গায়ে গোলার টুকরোর আঘাত লাগে । তাদের মধ্যে একজন প্রাণ হারান বলে জানিয়েছেন নিহতের স্ত্রী।
এতে আরও বলা হয়, ট্যাংকের আঘাত করার নির্দেশ দেয়ার সময়ে সেখানে উপস্থিত কমান্ডাররা “পেশাগত ও দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত” নেন। এতে বলা হয় যে বাড়িটির ভেতরে বন্দুকের গুলির শব্দ এবং জঙ্গিদের এ কথা শোনার পর যে তারা জিম্মিদের এবং নিজেদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে বিভিন্ন কমান্ডার যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ টিম বুঝতে পারে যে সন্ত্রাসবাদিরা অধিকাংশ জিম্মিকেই সম্ভবত হত্যা করেছে”।
এই প্রতিবেদনে সামরিক বাহিনীর আসতে বেশ কয়েক ঘন্টা বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় যে পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝেই বিকেল অবধি তারা কিবুতস’এর বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে আর তখন সেখানকার বাশিন্দাদের হত্যা করা হয়।
প্রতিবেদনে “ বেই’ইয়েরির বাশিন্দাদের সাহস এবং কিবুতস’এর অসামরিক লোকজনের দ্রুত সাড়া দেয়ার বিষয়টির ”প্রশংসা করে বলেছে “ লড়াইয়ের ওই কয়েক ঘন্টার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল”।
ফিলিস্তিনি ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কড়া সমালোচনা করেছে, তারা বলছে তাদের তদন্তে তেমন কাউকে শাস্তি দেয়া হয় না।
কিবুতস’এর বাশিন্দারা এই প্রতিবেদন সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে, ওই দিন সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কিন্তু তারা যে দায়িত্ব নিয়েছে তার প্রশংসাও করেন।
৭ অক্টোবর হামাসের সন্ত্রাসী আক্রমণে সেখানকার বাশিন্দা মেঈর জারবিভ, যার এক ভাই ও বোন নিহত হন, এই প্রতিবেদনকে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে “ভাঁওতাবাজি” বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “ আমি এই প্রতিবেদন বিশ্বাস করি না এবং এ সম্পর্কে আমি কোন কিছুই বিশ্বাস করি না”।
তিনি বলেন তিনি এখনও বোঝেন না কিবুতস’এ আসতে এবং প্রবেশ করতে সেনাবাহিনীর বিলম্বের কারণ। “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না এখানে কি হয়েছিল । আমার কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই । সেনাবাহিনী ছিল কোথায়?”
সেখানকার সম্প্রদায় এক বিবৃতিতে এই তদন্তকে “ বিস্তারিত” বলে অভিহিত করে এবং বলে এতে তারা ওই দিনের লড়াইয়ের জটিলতা বুঝতে পারছে।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ আমরা এখানে সেনাবাহিনীর বিশাল গুরুত্ব অনুধাবন করি যখন তারা আমাদের সুরক্ষা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার জন্য সমস্ত দোষ ও দায়িত্ব স্বীকার করে এবং শয়তানের চেয়েও খারাপ এই আক্রমণের সময়ে আমাদের কয়েক ঘন্টার জন্য পরিত্যাগ করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে”।
৭ অক্টোবরে ব্যাপকতর ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য কিবুতস সরকারি কমিশন গঠনের আহ্বান জানায় যাতে, “যে অকল্পনীয় ক্ষতি আমাদের হলো এমন ক্ষতি যেন আর কোন নাগরিকের না হয়”।
সীমান্তের ওপার থেকে আকস্মিক এই আক্রমণে প্রায় ১২০০ লোক নিহত হন, যাদের অধিকাংশই অসামরিক নাগরিক , এবং আরও ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। এটি ছিল ইসরায়েলের ৭৬ বছরের ইতিহাসে সব চেয়ে মারাত্মক আক্রমণ । এই আক্রমণে কয়েক হাজার জঙ্গি কোন বাধা ছাড়াই ঝড়ের বেগে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং তাতে সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি, তাদের গোয়েন্দা মূল্যায়ন এবং গাজার প্রতি তাদের রাজনৈতিক নেতাদের নীতিমালার মারাত্মক ঘাটতি পাওয়া যায়।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী ওই আক্রমণের পাল্টা জবাবে ইসরায়েলি আক্রমণে ৩৮,০০০’এর ও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন , ওই অঞ্চলের ৮০% মানুষ বাস্ত্তুচ্যূত হন এবং গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের সূচনা হল। ইসরায়েল এখন যুদ্ধাপরাধের সম্মুখীন এবং আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত।
অক্টোবর ৭ ‘এর ঘটনার ব্যর্থতার বিষয়ে সেনাবাহিনী একাধিক তদন্ত শুরু করেছে এবং সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান পদত্যাগ করেছেন। আরও বহু সামরিক কমান্ডার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন।
তবে যুদ্ধের এই দশ মাস পরও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারী স্তরের তদন্তের ব্যাপারে একাধিক আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন।
নেতেনিয়াহু বলেন দেশটি যখন হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোযোগ দিচ্ছে তখন কোন তদন্ত হতে পারে না এবং যথাস ময়ে সব প্রশ্নের জবাব দেয়া হবে। তবে সমালোচকরা ইসরায়েলি নেতার এই বলে সমালোচনা করছেন যে তিনি তার নীতি ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনাকে পাশ কাটানোর জন্য অন্যদিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
বৃহস্পতিবার সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যাল্যান্ট বলেন দেশের নেতৃত্ব সম্পর্কে তদরন্তের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় কমিশন গঠনের সময় এসেছে এখন।
তিনি বলেন, “(এই কমিশন) প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে আমাকে তদন্ত করবে। প্রধানমন্ত্রীকে তদন্ত করবে”।
প্রচন্ড আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে, নেতেনিয়াহু হামাসের সামরিক ও শাসন করার ক্ষমতা খর্ব না করা এবং অবশিষ্ট ১২০ জন পণবন্দির বাড়িতে না ফেরা অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। এ দিকে হাজার হাজার ইসরায়েলি নেতেনিয়াহুকে অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি সম্পাদনের আহ্বান জানিয়ে সাপ্তাহিক প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে । তারা বলছে পণবন্দিদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার সময় বয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে অস্ত্রবিরতি করানোর প্রচেষ্টা নতুন করে শুরু করেছেন।
বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন যে তিনি অস্ত্র বিরতি আলোচনা অব্যাহত রাখার জন্য কায়রোতে আলোচনাকারীদের একটি দল পাঠাচ্ছেন কিন্তু ইসরায়েল লক্ষ্য অর্জন না করা অবধি যুদ্ধ না থামানোর ব্যাপারে তার অবস্থান পুনঃব্যক্ত করেছে।
ওই একই সামরিক অনুষ্ঠানে যখন তিনি, “ যতই সময় লাগুক বিজয় অর্জন না হওয়া অবধি”যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেন তখন , লোকজন তাকে থামিয়ে দেয় এবং তারা শ্লোগান দেয়, “লজ্জা”।