আফগানিস্তানে তালিবানের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করার প্রচেষ্টা তার অধিবাসীদের জন্য অনেকটা শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসছে তবে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংগৃহীত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে এই সাময়িক স্বস্তি দীর্ঘিদন বহাল থাকবে না।
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা নজরদারি টিম বুধবার রাতে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে আল ক্বায়দা ও ইসলামিক স্টেটের মত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি সেখানে নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে কিংবা তালিবানের দূর্বলতার সুযোগে আফগানিস্তান নিশ্চিত ভাবেই নিরাপত্তাহীনতার উৎস হয়েই থাকবে।
প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে “ দেশটিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর জন্য অনুমতিদায়ক কিংবা বন্ধু-বৎসল অঞ্চল বলেই মনে করা হয়। অনেক আফগান প্রদেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠিগুলোকে তালিবানের অব্যাহতভাবে সহ্য করার কারণে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোতে সন্ত্রাসবাদ বিস্তৃত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে”।
বিশেষত আল-ক্বায়দা, নিজেকে আড়াল করে রাখতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, তালিবানের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে।
আল-ক্বায়দার বিস্তৃতি
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি মত দিয়েছে যে আল-ক্বায়দা, পূর্বাঞ্চলীয় শহর জালালাবাদে ঘাঁটি এবং কাবুলে দপ্তর স্থাপনসহ কমপক্ষে পাঁচটি আফগান প্রদেশে প্রশিক্ষণ শিবির ও নিরাপদ বাসস্থান গড়ে নেটওয়ার্ক গঠনের মাধ্যমে নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করে আরও লোক দলে নেয়ার জন্য অতীতের বছরগুলিকে কাজে লাগিয়েছে।
এই বিস্তৃতি আল-ক্বায়দার অন্যান্য সক্রিয়বাদিদের আকর্ষণ করেছে যাদের মধ্যে রয়েছে , জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যাদের বর্ণনা করা হয়েছে “ অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক” হিসেবে । তারা আফগানিস্তানের বাইরের লোক এবং যাদের মিশন হচ্ছে, “ ছত্রভঙ্গ কেন্দ্রগুলির নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা”।
এই প্রতিবেদনে আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে কার্যত আল-ক্বায়দার নেতা সাইফ-এল-আদেল আরব জাতিগোষ্ঠীর সক্রিয়বাদিদের আফগানিস্তানের কুনার ও নুরিস্তান প্রদেশে পাঠাচ্ছেন যাতে প্রশিক্ষণ উন্নত করা যায় এবং গোষ্ঠীটির মূল নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা বাড়ানো যায়। মনে করা হচ্ছে সাইফ –আল-আদেল ইরানে রয়েছেন।
তালিবানের কারণেই আফগানিস্তানে আল-ক্বয়দার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাও আরো নিরাপত্তা পেয়েছেন।
তালিবানের সুরক্ষা প্রদান
২০১০ সালে আটক আল-ক্বায়দার কমান্ডার আবু ইখলাস আল-মাসরি, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করা পর্যন্ত বাগরাম বিমান ঘাঁটির একটি কারাগারে আটক ছিলেন; তাকে পরে নিরাপদ হেফাজতে রাখা হয় এবং যেমনটি ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, “ এতে তালিবানের এ রকম উদ্বেগেরই প্রতিফলন ঘটে যে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তার খোঁজ করছে”।
এই প্রতিবেদনে আরো দু’জন আল-ক্বায়দা কর্মকর্তাকে “ অস্ত্র প্রকৌশলী” বলে বর্ণনা করা হয়েছে যাদেরকে তালিবান সুরক্ষা প্রদান করেছিল। তা ছাড়া লিবিয়ায় একজন আল-ক্বায়দা কর্মকর্তাকে আফগান পাসপোর্ট প্রদান করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একটি পদে নিয়োগ দান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আল-ক্বায়দা সম্পর্কে এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “ এই সব কর্মকান্ডের পেছনের উদ্দেশ্যটা পরিস্কার নয়, তবে এই কর্মকান্ডগুলি যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে”।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র যে ভাবে মূল্যায়ন করেছিল, তা থেকে জাতিসংঘের মূল্যায়ন কোন কোন দিকে ভিন্ন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার বার্ষিকীতে ন্যাশনাল কাউন্টার টেরোরিজম সেন্টারের ডিরেক্টর ক্রিস্টিন আবিজায়েদ বলেন, “আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আল-ক্বায়দার যে ঐতিহাসিক পতন ঘটেছে তার থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই”। ঐ হামলায় প্রায় ৩,০০০ লোক প্রাণ হারান।
তবে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেওয়া ছবির সঙ্গে এ ধরণের মন্তব্য আদৌ মেলে না। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে আল-ক্বায়দার ৩০ থেকে ৬০ জন শীর্ষ কর্মকর্তা আফগানিস্তানে রয়েছেন । তাছাড়া শত শত যোদ্ধা ও পরিবারের ২,০০০ সদস্যও রয়েছে।
ইসলামিক স্টেট খোরাসান
আফগানিস্তানে যখন তালিবান শাসন আমলে আল-ক্বায়দার পুনরুত্থান হয়ত শুরু হচ্ছে, জাতিসংঘের নতুন প্রতিবেদেনে দেওয়া গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট চাপের মুখে রয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে যে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি , “[ আই-এস খোরাসানের হুমকি মোকাবিলায় তালিবানের প্রচেষ্টাকে কৃতিত্ব দিচ্ছে। কিন্তু ( তারা) সন্ত্রাসবাদ দমনে তালিবানের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করছে এবং অব্যাহত ভাবে [ আইএস-খোরাসানে লোক নিয়োগ ও ছড়িয়ে পড়া নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন”।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর ফলে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সম্পৃক্তরা তালিবান শাসনকে খর্ব করার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করছে এবং একই সঙ্গে ইরান ও রাশিয়া পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে আইএস –খোরাসানের সক্ষমতা “ শক্তই থাকছে” । বিশেষ করে প্রতিবেদনটিতে আলোকপাত করা হয় গত জানুয়ারি মাসে ইরানের কারমানে ও মার্চ মাসে মস্কোর কনসার্ট হলে এই গোষ্ঠীর প্রাণনাশী হামলার উপর।
বিস্তৃত হয়েছে আইএস খোরাসান
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে পার্শ্ববর্তী মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে আইএস-খোরাসান বিস্তৃত হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে আইএস-খোরাসান “ আফগান নাগরিকদের পাকিস্তানে আক্রমণ চালাতে, পাকিস্তানি নাগরিকদের আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে, তাজিক নাগরিকদের ইরান ও রুশ ফেডারেশনে এবং কিরগিজ নাগরিকদের তালিবানের কেন্দ্রস্থল কান্দাহারে আক্রমণ চালাতে ব্যবহার করছে”।
এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রতিবেদনটির মতে, “ তারা আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে নিজেদের শক্তিশালী করেছে, তাজিক ও উজবেক সম্প্রদায় থেকে লোকজনকে অন্তর্ভুক্ত করছে এবং সুদূর পার্বত্য এলাকায় অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক জড়ো করছে।
জাতিসংঘের অন্যতম একটি সদস্যরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়েছে যে তারা এমন আভাস পাচ্ছে যে আইএস-খোরাসান কোন কোন এলাকায় নিজেদের আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠা করার প্রস্তুতি নিতে পারে।
ছদ্মবেশি আইএস
জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলি আরো যে সব গোপন তথ্য দিয়েছে তাতে এ রকম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে আই-এস খোরাসান তালিবানের ভেতরে প্রবেশ করেই তালিবানের পতন ঘটানোর প্রস্তুতি নিতে পারে।
প্রতিবেদন বলছে যে আএ রকম প্রমাণ রয়েছে যে আই্এস-খোরাসান সক্রিয়বাদিরা তালিবানের স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা পরিদপ্তরে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা যে তাদের উপস্থিতির বিষয়টি লুকানোর উপায় খুঁজে বের করছে সে নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
প্রতিবেদনের হিসেব অনুযায়ী আইএস-খোরাসানের ২,০০০ থেকে ৩,০০০ যোদ্ধারা আফগানিস্তানে রয়েছে। অন্যান্য সম্পৃক্ত আইএস যোদ্ধা মিলিয়ে সেই সংখ্যা ৬,০০০ হতে পারে।
তবে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলির অভিযোগ হচ্ছে যে এই গোষ্ঠীটি তাদের যোদ্ধাদের আরো চারটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে তাদের অন্তর্ভুক্ত করছে। এদের মধ্যে এমন কিছু গোষ্ঠীও রয়েছে যারা তালিবান শাসিত সরকারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও কল্যাণ ভাতা পেয়ে থাকে।
আইএস: বিশেষ বাহিনী
এমন কিছু প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে আইএস খোরাসান ইরানে বিশেষ অভিযানের জন্য বাহিনী গঠন করেছে।
জাতিসংঘের দু’টি সদস্য রাষ্ট্রের মতে প্রধানত তাজিক ও উজবেক নাগরিকদের সমন্বয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়েছে এবং তাদের কাজ হচ্ছে শিয়াদের পবিত্র স্থান, ধর্মীয় নেতা ও ইরানের পুলিশের উপর হামলা চালানো।
জাতিসংগের এই দুটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র বলছে যে এই বাহিনীতে ৩০০ জন যোদ্ধা থাকতে পারে এবং মনে হচ্ছে তারা পাকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান ও ইরাকের সঙ্গে ইরানের সীমান্ত এলাকায় এই অভিযান চালাচ্ছে।
মধ্য এশিয়া
আফগানিস্তানে আল ক্বায়দার ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতিসংঘের মূল্যায়নের মতই সে দেশে আই এস এর বিরাট সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের বিপরীত । যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তাদের উপস্থিতি নামমাত্র।
তবে মধ্য এশিয়া ও তার বাইরে শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আই এস’এর সক্ষমতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের অতি সাম্প্রতিক হিসেব উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
গত মাসে সন্ত্রাসবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সতর্ক করে দেন যে আই এস অভিবাসনের নতুন ধরণের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে যেখানে আরো বেশি সংখ্যক মধ্যএশিয়াবাসীদের মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের সীমান্তের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী তৎপরতা
কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেওয়া আরও বিস্তারিত রিপোর্ট এই প্রমাণই বহন করে যে আইএস-খোরাসান , যারা আইএসকেপি নামেও পরিচিত তারা উদ্বেগর কারণ হয়েই থাকছে।
বৈশ্বিক গোয়েন্দ প্রতিষ্ঠান , দ্য সৌফান সেন্টারের রিসার্চ ফেলো লুকাস ওয়েবারের মতে, “ আফগানিস্তান থেক যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রতাহার এবং ২০২২ সালে তাজিক ও উজবেক মিডিয়া শাখা থেকে বেরিয়ে আসার পর আইএসকেপি মধ্যএশিয়ায় তার উপস্থিতি জোরালো করেছে”।
তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ এই উদ্যোগ অব্যাহত ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে । তিনি এই প্রসঙ্গে মস্কোতে সন্ত্রাসী আক্রমণের কয়েক দিন পরেই আই এস তাজিক ভাষায় তাদের নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা তুলে ধরেন।
আর, উদ্বিগ্ন বোধ করার আরো কিছু লক্ষণ রয়েছে।
ওয়েবার আরো বলেন , “ গত কয়েক মাস ধরে গোটা মধ্য এশিয়া জুড়ে আইএসকেপি’র সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তার করা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন তাতে এই আভাস পাওয়া যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে এই উচ্চ পর্যায়ের গ্রেপ্তার, “ গোষ্ঠীটি যে রকম পরিকল্পনা করেছে এ হচ্ছে তার সূচনা শুধু”।