সদ্য শেষ হওয়া ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ‘হিজড়া’ পরিচয়ে প্রার্থী হতে পেরেছিল হিজড়ারা। চার ধাপে অনুষ্ঠিত এই উপজেলা ভোটে প্রথমবার ভোটে অংশ নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন দুজন হিজড়া। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার দাবি করছেন তারা।
গত (১৯ মার্চ) উপজেলা নির্বাচনের সংশোধনী বিধিমালায়—মনোনয়নপত্রে লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে পুরুষ, মহিলার পাশাপাশি ‘হিজড়া’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ হিজড়ারা তাদের নিজস্ব পরিচয়ে প্রথমবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পান। অন্য জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এই বিধান আগেই সংযুক্ত ছিল।
কাজ করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও চেয়ারম্যানদের বাধার মুখে হিজড়া জনপ্রতিনিধিরা
গত ৯ মে ঝিনাইদহ উপজেলা পরিষদ নির্বাচেন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ‘হিজড়া’ মীর বর্ষা খাতুন আর ২১ মে জামালপুর দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মুন্নী আক্তার।
মুন্নী আক্তার বলেন, “এবার প্রথমবার আমি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। জয়লাভ করেছি। এর আগে একবার অংশ নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তখন নির্বাচনে দাঁড়ানোর মতো বয়স ছিল না।”
তিনি বলেন, “এখন দেশে এবং আমার সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা আছে। স্থানীয় সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী আমার নামে অনেক কিছু বরাদ্দ হওয়ার কথা। আমার অধীনে ৯টি কমিটি থাকার কথা।”
“কিন্তু তারা আমাকে এখন কোনো কমিটি করতে দেয়নি। পরিষদের চেয়ারম্যান যা বলে ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) তাই করে। আমার কথা শোনে না, কোনো গুরুত্ব দেয় না” বলে অভিযোগ করেন মুন্নী আক্তার।
ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নেওয়ার পর নিজের নামে কোনো বরাদ্দ পাননি বলেও জানান মুন্নী আক্তার।
এই জনপ্রতিনিধি বলেন, “তারা আমাকে কোনো দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে না। আমার বসার রুমের অবস্থা পিয়নের রুমের চাইতেও খারাপ। একটা ভাঙা চেয়ার দেওয়া হয়েছে বসার জন্য। এখন সবকিছু লিখিত আকারে রাখছি। আরও কিছুদিন সময় নেব। তারপর আমি অভিযোগ দেব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। প্রয়োজনে সংবাদ সম্মেলন করব।”
তিনি আরও বলেন, “আমি কিছু বললে, চেয়ারম্যান বলেন—জুন ক্লোজিং হোক (পুরোনো অর্থবছর শেষ হোক)। অথচ ঈদের পরে গত ২১ তারিখ অফিস খুলেছে। এর মধ্যে অনেক কার্যক্রম হয়েছে। কিন্তু আমাকে সেখানে ডাকা হয়নি। রিলিফের চাল দিয়েছে আটটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায়। চেয়ারম্যান নিজে প্রতিটি ইউনিয়নে চাল দিয়েছেন। কিন্তু আমরা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ৫০ জন লোককে সহযোগিতা করতে পারিনি। কারণ, আমাদের নামে কোনো বরাদ্দ দেয়নি।”
নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে নানান পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান মুন্নী আক্তার।
তিনি বলেন, “আমি চাই তাদের কর্মমুখী করা। আমি ডিসির কাছে একটা আবেদন করেছি তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে। যদিও এখন কোনো সাড়া পাইনি আমি। যারা কর্মমুখী হতে চায়, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করা।”
“মানুষ খুব ভালোবেসে আশা নিয়ে ভোট দিয়েছে। যাতে আমরা দুর্নীতি থেকে দূরে থেকে কাজ করতে পারি। কিন্তু চেয়ারম্যান আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না” বলে যোগ করেন মুন্নী আক্তার।
“নিজ পরিবারের লোকজন যথেষ্ট পরিমাণে সহযোগিতা করেছে” বলে উল্লেখ করেন মুন্নী আক্তার।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার পরিবার সব সময় সহযোগিতা করে আসছে। আমি যখন আমার সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে চলে এসেছি, তখনও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।
অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমাদের নামে তো কোনো বরাদ্দ আসেনি। মাত্র যাত্রা শুরু হয়েছে। নতুন অর্থবছর তো শুরু হয় জুলাই থেকে। বরাদ্দ এলে নীতিমালা অনুযায়ী সবই পাবে। এখানে বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। তারা নতুন নির্বাচিত হয়েছে, তাই নিয়মকানুন বোঝে না।”
তিনি বলেন, “ঈদের সময় যে রিলিফ বিতরণ হয়েছে, সেইগুলো আসে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নামে। সেইগুলো তারাই বিতরণ করে। এখন তিনি যদি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে সেখান থেকে তাঁর নামে বরাদ্দ চান, সেটা তো হবে না। কারণ, এটা আমাদের নীতিমালায় নেই। নীতিমালার বাইরে তো কিছু করা যাবে না।”
ঝিনাইদহ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মীর বর্ষা খাতুন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “প্রথমবার ভোটে অংশ নিয়ে মানুষের ভালোবাসায় নির্বাচিত হয়েছি। এখন সবার জন্য কাজ করতে চাই। সমস্যা তো কিছু আছেই। তবে এসব নিয়ে এখনই কথা বলতে চাই না। সামনের দিকে কী হয়, সেটি আগে দেখতে চাই।”
তিনি আরও বলেন, “আমি উদ্যোগ নিয়ে মহিলা ও হিজড়াদের জন্য কাজ করব। যাতে অন্য মানুষের মতো হিজড়ারাও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। তারাও যেন কর্মমুখী হয়। সমাজের বোঝা নয়, সম্পদ হিসেবে বাঁচতে হবে।”
তাঁর মতো অন্য হিজড়াদের রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান বর্ষা। তিনি বলেন, “নিজের অধিকার নিয়ে কাজ করতে হলে রাজনীতিতে আসতে হবে। নিজেদের বঞ্চনার কথা বলতে হবে।”