বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলেরর জেলাগুলোতে বৃষ্টি হচ্ছে বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। ভারতের চেরাপুঞ্জি এলাকায় অব্যাহত রয়েছে প্রবল বর্ষণ। এর ফলে, বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় আবার বন্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির কারণে সাজেক-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সাজেক ভ্যালিতে আটকা পড়েছে তিন শতাধিক পর্যটক।
সাজেক ভ্যালিতে পাহাড়ি ঢল
টানা বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি ঢল নেমে সাজেক-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে, সাজেক ভ্যালিতে তিন শতাধিক পর্যটক আটকা পড়েছে।
সোমবার (২ জুলাই) দিবাগত মধ্যরাত থেকে ভারী বৃষ্টিাত শুরু হয়। এরপর, পাহাড়ি ঢলে বাঘাইহাট বাজারে সড়ক এবং বেইলি ব্রিজ তলিয়ে যায়। এতে সাজেকের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মঙ্গলবার (২ জুলাই) সকালে পাহাড়ি ঢলে সড়ক ডুবে গেলে বাঘাইহাট থেকে কোনো গাড়ি সাজেক যেতে পারেনি এবং সাজেক থেকেও কোনো পর্যটকবাহী গাড়ি আসতে পারেনি।
সাজেক জিপ সমিতির লাইনম্যান ইয়াসিন আরাফাত বলেন, অতিবৃষ্টিতে সোমবার মধ্যরাত থেকে বাঘাইহাট বাজার এবং মাচালং বাজারে ঢলের পানি বাড়তে শুরু করে। বাঘাইহাট বাজারে কোমড়পানি উঠে যায়। তাই সাজেক সড়কে কোনো যানবাহন চালানো যায়নি। সোমবার এবং এর আগে যে পর্যটকরা সাজেকে এসেছিলেন, তারা ফিরতে পারছেন না। খাগড়াছড়ি থেকেও কোনো গাড়ি সাজেকের উদ্দেশে ছেড়ে আসেনি।
সাজেক মেঘপুঞ্জি রিসোর্টের ব্যবস্থাপক পুষ্প চাকমা বলেন, কয়েকদিন ধরে সাজেকে বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে পর্যটকের সংখ্যা কম। তিনশ’র বেশি পর্যটক সাজেকে আটকা পড়েছেন। বৃষ্টির কারণে বাইরে বেড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে রিসোর্টের কটেজেই অবস্থান করছেন সবাই।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরীন আক্তার বলেন, টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সড়ক ও বাঘাইছড়ির বাঘাইহাট বাজার ডুবে গেছে। তিন শতাধিক পর্যটক সাজেকে আটকা পড়েছে।
এছাড়া, বাঘাইছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় উপজেলায় ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসার আহবান জানানো হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
সিলেটে আবার বন্যা
ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে আবার বন্যা দেখা দিয়েছে সিলেটের ৩ উপজেলায়। দ্রুত বাড়ছে সুরমা-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি।
সোমবার (১ জুলাই) বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় সিলেটে ৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৩৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
মঙ্গলবারও সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। চেরাপুঞ্জি ও সিলেটের বৃষ্টিপাতের কারণে দ্রুতগতিতে বাড়ছে নদ-নদীর পানি।
আবহাওয়া বিভাগের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. শাহ্ সজিব হোসেন জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার। এর মধ্যে বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বিকালের পর থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরো বেড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট অফিস থেকে জানানো হয়েছে, অতিবৃষ্টির কারণে সিলেটের নদ-নদীগুলোর ৪টি পয়েন্টে পানি বিপদ সীমা ছাড়িয়েছে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদ সীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং জৈন্তাপুরে সারি নদীর পানি বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া জকিগঞ্জের আমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি বিপদ সীমার ২৮ মিলিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফেঞ্চুগঞ্জে একই নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বিপদ সীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া বাকি ৭ পয়েন্টেও নদীর পানি আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে।
এদিকে, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে পুনরায় সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকায় বাড়িঘর, বাজার-দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া মহানগরের উপশহর এলাকা আবার প্লাবিত হয়েছে।
মাত্র ৩৫ দিনের মধ্যে সিলেটে তৃতীয়বার বন্যার কবলে পড়লো সিলেট। দ্বিতীয় দফার বন্যায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী হয়ে আছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে, অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সোমবার (১ জুলাই) নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে জেলার ৩টি উপজেলায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন; আগামী ৪ দিন সিলেটে ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা হলে সিলেটে নতুন বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
সিলেটে গত ২৭ মেবন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২ সপ্তাহ স্থায়ী এ বন্যায় পানিবন্দী ছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে আবার বন্যা হয় সিলেটে। ১৭ জুন ঈদুল আজহার দিন ভোররাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিভারী বর্ষণে মহানগরসহ সিলেটের সব উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ জলবন্দী হয়ে পনে। পরবর্তী এক সপ্তাহ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ছিলো ভয়াবহ। এরপর পানি নামতে শুরু করে। তবে, খুব ধীর গতিতে।
দ্বিতীয় দফা বন্যা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার (১ জুলাই) থেকে সিলেটে ধাক্কা দেয় তৃতীয় দফা বন্যা। সোমবার সকালে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কানাইঘাটে সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে।
ফলে, আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি স্থান দিয়ে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার অনেক এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায় সিলেটের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
চেরাপুঞ্জিতে ঢল,পানিবন্দী সুনামগঞ্জবাসী
প্রথম দফা বানের জল না শুকাতেই, আবার বন্যার কবলে পড়ছে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা। ভারতের চেরাপুঞ্জি অঞ্চল থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আবার বাড়ছে সুনামগঞ্জের সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটাসহ সকল নদনদীর পানি।
সোমবার (১ জুলাই) দুপুরে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর ফলে ডুবেছে সুনামগঞ্জ শহরসহ জেলার নিম্নাঞ্চল। সেইসঙ্গে ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক। আবার বন্যার মুখে পড়েছেন জেলার ২৫ লাখ মানুষ।
পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার উত্তর আরপিননগর, সাহেববাড়ি ঘাট ও পুরানপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দূর্গাপুর সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জেলা শহরের সঙ্গে আবার তাহিরপুর উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এছাড়া ছাতক, দোয়ারাবাজার, মধ্যনগরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের গ্রামীণ সড়ক এখন পানির নিচে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন পাঁচ লাখের বেশি মানুষ।
তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহমান জানান, সকল নদীর পানি আবার বাড়ছে। সড়কে পানি ওঠায় জেলা শহরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখন সুনামগঞ্জে যেতে হচ্ছে নৌকায়।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জে নদনদীর পানি ইতোমধ্যে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কমে গেলে নদনদীর পানি কমে যাবে। এখন পানি বাড়ছে, ফলে জেলায় স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।”
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা
এদিকে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গত দুই সপ্তাহে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া বন্যায় ঘরছাড়া হয়েছে ৩ লাখের বেশি মানুষ। বন্যায় ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী আসাম রাজ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনী এ রাজ্যে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) ব্রহ্মপুত্রের একটি ছোট দ্বীপে চারদিন ধরে আটকে থাকার পর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ১৩ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের আগে আসামের ওপর দিয়ে ১২৮০ কিলোমিটার বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে নদের পানি উপচে দুপাড়ে ব্যাপক প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এ বছরের আগাম বৃষ্টিপাতের কারণে নদের দুপাড় এবং এর মাঝে থাকা ২ হাজারের বেশি দ্বীপের বাসিন্দারা আগেভাগেই বিপাকে পড়েছেন।
আসামের বিখ্যাত কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের প্রাণীরাও বন্যার পানি থেকে বাঁচতে উঁচু জমিতে গিয়ে উঠছে। পার্কটিতে প্রায় আড়াই হাজার এক শিংওয়ালা গন্ডার রয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, পার্ক রেঞ্জাররা প্রাণীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে সর্বক্ষণ তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন।
এদিকে, আসামের পাশের রাজ্য চীনের সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশে ভূমিধসে বেশ কয়েকটি রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, রাজ্যের চাংলাং জেলার একটি স্কুল থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী।
এ ছাড়াও, সিকিম, মণিপুর ও মেঘালয় রাজ্যে প্রবল বন্যায় রাস্তা ভেসে গেছে, ভেঙে পড়েছে সেতু। ভারতের সরকারি হিসাব অনুসারে, বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসের কারণে মে মাসের শেষ থেকে এ পর্যন্ত দেশটির উত্তর-পূর্বের ছয়টি রাজ্যে ৮০ জনের বেশি লোক নিহত হয়েছে।