খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকৃত বিপুল ঋণের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখন নাজুক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। বিতরণকৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে পরিণত হওয়ায় ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্য সংকটের মধ্যে রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেতিবাচক এ সূচকটি লাফিয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা একে প্রাণঘাতী রোগ ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভুল নীতি এবং খেলাপিদের বারবার সুবিধা দেওয়ার কারণে এটি বেড়ে চলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে পুরোপুরি ব্যর্থ। গত এক বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে বর্তমানে খেলাপি ঋণ দেশটির ইতিহাসে রেকর্ড ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণগ্রহীতাদের নানামুখী সুযোগ দিয়ে আমরা বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করে গেছি, কিন্তু সেটি কাজ করেনি। সুযোগসন্ধানীরা আরও বেশি সুবিধা নিতে ঋণের অপব্যবহার করেছে। ফলে খেলাপি ঋণ অর্থনীতির ক্যান্সারের রূপ নিয়েছে। এখন সময় এসেছে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তির পথ খোঁজার।
তবে দিনদিন খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পেছনে আইনি প্রক্রিয়া তথা নিয়মের জটিলতা আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। তাঁর মতে, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে থাকায় দ্রুত পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। আর আইনি জটিলতায় মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বছরের পর বছর সুদ বেড়ে মোট অঙ্ক বড় হয়ে যাচ্ছে।
এ গতি থামানোর জন্য আইনি প্রক্রিয়া সহজ করতে কাজ চলছে। তাছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করার বিষয়ে নীতিমালা করা হয়েছে। অপরদিকে মামলার সংখ্যা কমানোর জন্য সমঝোতার মাধ্যমে ঋণ উত্তোলন বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে সফলতা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে– ভয়েস অফ আমেরিকাকে এসব কথা জানান মেজবাউল হক।
বর্তমানে খেলাপি ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সর্বকালের সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ১১ দশমিক ১১ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত ১ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটাই খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র নয়। লুকানো খেলাপি ঋণ এর চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা অর্থ হিসাব করে মোট খেলাপি ঋণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি থেকে ৫ লাখ কোটি টাকার মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ সম্পত্তি। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে। আইএমএফের পরামর্শে তথ্যটি প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ২০২৩ সালভিত্তিক প্রতিবেদনটি এখনও প্রকাশিত হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসূত্র বলছে, এবার ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশ স্পর্শ করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “খেলাপি ঋণ এখন ব্যাংকের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংক মূলধন খেয়ে ফেলছে।” তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো নামে-বেনামে ঋণ দিচ্ছে; কোনো যাচাই-বাছাই হচ্ছে না। বিশেষ সুবিধায় এসব ঋণ পুনর্গঠনও করা হচ্ছে। তারপরও এর অর্থ পরিশোধ করছে না; ফলে বেড়েই চলছে খেলাপি ঋণ।”
কোন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কত
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৯৮৮ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসির (বিডিবিপি) খেলাপি ঋণ ৮৭৩ কোটি টাকা। মার্চ শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ২৭ শতাংশই খেলাপি। যদিও আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে।
অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা; যা বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। আইএমএফ এটি ৫ শতাংশের নিচে রাখতে বলেছে।
বিদেশি ব্যাংকগুলোতে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা; যা বেড়ে হয়েছে ঋণের ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
বিশেষায়িত দুই ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
গত ২৪ বছরে খেলাপি ঋণের চিত্র
২০০১ সালে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত ২৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা; যা বাংলাদেশে জাতীয় বজেটের এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক নজিরবিহীন হারে বেড়েছে। ২০০৯ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন ২ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।
কোন সময়ে খেলাাপি ঋণ বেশি বেড়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে ২০২২ সালের ১২ জুলাই দায়িত্ব নেন আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আকার ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত মার্চে এটি ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার ২১ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এটি গভর্নর হিসেবে খেলাপি ঋণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; তবে স্বল্প সময়ে বৃদ্ধির হার বিবেচনায় প্রথম।
আব্দুর রউফ তালুকদারের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ফজলে কবির। তিনি দুই মেয়াদে সাত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তাঁর দুই মেয়াদে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, যার পরিমাণ ৬৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। তিনি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১৬ সালের ২২ মার্চ। ওই সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। তার দুই মেয়াদের দায়িত্ব শেষ হয় ২০২২ সালের ৩ জুলাই। অবসরে যাওয়ার আগে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
ফজলে কবিরের আগে ২০০৯ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ড. আতিউর রহমান। প্রথম মেয়াদে চার বছর পূর্ণ হলে সরকার তাঁর মেয়াদ বাড়ায়। দ্বিতীয়বার আরও চার বছরের জন্য দায়িত্ব পেলেও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তাঁকে আগেই পদত্যাগ করতে হয়।
তাঁর দুই মেয়াদে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেখে যায় ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকার। ব্যাংক খাতের তৃতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ বেড়েছিল এ গভর্নরের আমলে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৫ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। ওই সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তিনি বিদায় নেন ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল। বিদায় নেওয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই গভর্নরের আমলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অষ্টম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। ১১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়ে শুরু করে ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গভর্নর হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা।
যেসব নীতি ছাড়ের কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের পর প্রথমেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
এরপর করোনা শুরু হলে সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয়। এ সময় কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে এসেই ঋণখেলাপিদের গণছাড় দিয়ে নতুন এক নীতিমালা জারি করেন। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।
নতুন নীতিমালায় খেলাপি ঋণের সুবিধা প্রদান ও পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংক মালিকরাই ঠিক করছেন কোন ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাবে। আগে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এর ফলে খেলাপি ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরও বেড়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল করা হয়। সর্বশেষ ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে আরও এক দফা ছাড় দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেয়, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। এতে ঋণখেলাপি কোম্পানির নতুন ঋণ পাওয়ার দরজা খুলে যায়।
এ প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংক খাতে সুশাসনের চরম ঘাটতি চলছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়া হয় না। এটিই এখন দেশের বিজনেস মডেল।”
ছাড় পাচ্ছেন প্রভাবশালীরা
ব্যাংক ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় পাচ্ছে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। অপরদিকে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা লঘু পাপে পাচ্ছেন গুরু দণ্ড। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের গ্রাহক অ্যাননটেক্স গ্রুপকে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ সুবিধা দেয় ব্যাংকটি। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অ্যাননটেক্স গ্রুপের কাছে আরোপিত, অনারোপিত সুদসহ ব্যাংকের পাওনা ছিল ৮ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এককালীন ঋণ পরিশোধ সুবিধার (ওয়ান টাইম এক্সিট) আওতায় ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সুদ মওকুফ-পরবর্তী ৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করার শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করেনি গ্রুপটি। নতুন করে সুদ যোগ হয়ে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুদ মওকুফ বহাল রেখে নতুন করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এভাবে বড় গ্রাহকদের নিয়মিত ছাড় দিয়ে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
অপরদিকে ২০২২ সালের নভেম্বরে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ৩৭ জন কৃষকের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১২ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। অথচ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং ওয়ারেন্ট হলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে সুদ মওকুফের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন মুখপাত্র। তিনি বলেন, “কেবল আর্থিক কারণ বিবেচনায় নিয়েই সুদ মওকুফ হয়। কোনো অনিয়ম হলে সে ক্ষেত্রে নীতিমালা কার্যকর হয় না। তাছাড়া মামলা করতে গিয়ে ব্যাংকের অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক সুদ মওকুফ করে আসল অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করে।”
আইএমএফের মূল্যায়ন
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে একটি দীর্ঘ মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেখানে খেলাপি ঋণ বিষয়ে বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক। এখানে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তারা।”
খেলাপি ঋণের প্রভাব
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সাধারণত খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তৈরি হয়, যা নতুন ঋণ দিতে ব্যাংকের সামর্থ্য কমিয়ে দেয়। এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়; এতে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। মূলধন ঘাটতি থাকলে লভ্যাংশ ঘোষণা করা যায় না; ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। হতাশা থেকে তারা শেয়ার বিক্রি শুরু করলে ওই ব্যাংকের শেয়ার মূল্য আরও কমে যায়। এতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় খাতে দেখানো যায় না; তাই ব্যাংকের আর্থিক চিত্র আরও খারাপ দেখা যায়।
এ ছাড়া অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে যায়। ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। খেলাপি ঋণ অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ফলে দেশের রিজার্ভ কমে যায়। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের রিজার্ভ ধারাবাহিক কমার পেছনে খেলাপি ঋণ পাচার হয়ে যাওয়া একটা বড় কারণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রতি মাসে বাণিজ্যের আড়ালে অন্তত দেড় বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছিল। বর্তমানে এটি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকেরই নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
অন্যদিকে খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট তারল্য সংকট মোকাবিলায় অনেক ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে স্বল্পমেয়াদি ধার দিতে বাধ্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ‘হাই পাওয়ার্ড মানি’ মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
খেলাপি ঋণ কমাতে রোডম্যাপ
সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। এই পথনকশা বা রোডম্যাপের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামানো হবে, যা তখন ৯ শতাংশ ছিল। যদিও বর্তমানে এটি আরও অনেকটা বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, যা মার্চ শেষে যথাক্রমে ২৭ ও ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয় মেজবাউল হক বলেন, “খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি কাঠামো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব শিল্পকারখানার ওপর পড়েছে। নিয়ম না মানার প্রবণতাও রয়েছে; এ জন্য ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিতকরণ নীতিমালা করা হয়েছে। অপরদিকে আমাদের অর্থনীতি দিনদিন যত বড় হচ্ছে, এই রিস্কগুলো তত বাড়ছে।”
শাস্তি হয় না কেন
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকে দোষারোপ করা হয়। সাধারণত খেলাপি ঋণ কিংবা ঋণ জালিয়াতির ঘটনাগুলোর মামলা সহজে নিষ্পত্তি হয় না। কেবল হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য মামলাগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে কিন্তু নিষ্পত্তি হয় না।
সম্প্রতি বাজেট বিষয়ে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে গবেষণা সংস্থা সিপিডির ফেলো ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, যারা ঋণখেলাপি তারাই এখন ব্যাংকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তারাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নজরদারি করে এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রও আইনি জটিলতাকে দুষছেন। তিনি বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া বা বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে।”
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “যেহেতু খেলাপি ঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই আমরা এ বিষয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। কোর্টগুলো যাতে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সেজন্য আরও পাঁচটি কোর্ট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি চলমান আছে, শিগগিরই ঢাকায় তিনটি এবং চট্টগ্রামে আরও দুটি কোর্ট কাজ শুরু করবে।”