আইসিসি টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম সেমি ফাইনালে বুধবার (২৬ জুন) দক্ষিণ আফ্রিকা ৯ উইকেটে আফগানিস্তানকে গুড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মত ফাইনেল পৌঁছেছে।
প্রোটিয়াসদের জয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দলের বোলাররা, যখন তারা মাত্র ১১.৫ ওভারে ৫৬ রানে আফগানিস্তানের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটায়। ব্যাট করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা ৮.৫ ওভারে এক উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা অবশেষে তাদের ‘চোকার’ দুর্নাম থেকে রেহাই পেল।
ত্রিনিদাদের ব্রায়ান লারা ক্রিকেট একাডেমী মাঠে ফ্লাডলাইটের নিচে টসে জিতে আফগানিস্তানের অধিনায়ক রাশিদ খান প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন।
এই টুর্নামেন্টের একটি বড় দিক ছিল আফগানিস্তানের উদ্বোধনী জুটি রহমানউল্লাহ গুরবায এবং ইব্রাহিম যাদ্রান। তারা ছয়টি ম্যাচে দলের ইনিংসের সূচনা করেন এবং তার মধ্যে ৩টি সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ এবং একটিতে অর্ধশতকের জুটি গড়ে তোলেন। অন্য কোন দলের উদ্বোধনী ব্যাটাররা এরকম ধারাবাহিকভাবে বড় স্কোরের পার্টনারশিপ গড়তে পারেন নি।
গুরবায- যাদ্রান জুটি ভাঙ্গা জরুরী
ইনিংসের শুরুতে এই জুটি ভাঙ্গা দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য জরুরী ছিল এবং মারকো ইয়ানসেন ঠিক সেই কাজটিই করেন তার প্রথম ওভারে। গুরবায কোন রান করার আগেই ইয়ানসেনের বল এজ করে ক্যাচ তুলে দেন রিযা হেন্ড্রিক্স-এর হাতে।
ইয়ানসেন তার দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় বলে গুলবাদিন নাইবের স্টাম্প তছনছ করে দেয়। ইনিংসের তিন ওভার শেষ হবার আগেই আফগানিস্তান ১৬ রানের মাথায় ২ উইকেট হারায়।
চতুর্থ ওভারে বল শুরু করেন আরেক পেসার কাগিসো রাবাদা, এবং প্রথম বলেই যাদ্রানকে বোল্ড করেন। তিন বল পরেই রাবাদা মোহাম্মাদ নবীর অফ স্টাম্প উপড়ে ফেলেন। প্যাভিলিয়নের দিকে ব্যাটারদের মিছিল সেখানেই থামে নাই।
ইয়ানসেন তার তৃতীয় ওভারে – ইনিংসের পঞ্চম ওভার – নানগেয়ালিয়া খারোতের উইকেট দখল করেন। লেগ সাইড দিয়ে উঁচুতে ওঠা বল খারোতে হুক করার চেষ্টা করলে উইকেটকিপার কোইয়েন্টিন ডি ককের হাতে ক্যাচ তুলে দেন।
আফগানিস্তান তখন সম্পূর্ণ নতুন, অপরিচিত বাস্তবতার মুখোমুখি – পাওয়ার প্লের মাঝেই ২৩ রানের মাথায় পাঁচটি টপ অর্ডার ব্যাটারের বিদায়। আফগানিস্তানের ব্যাটিং-এর গভীরতা, তাদের মিডল এবং লোয়ার অর্ডারের মানসিক শক্তি, রশিদ খানের অধিনায়কত্ত – সব কিছুর চরম পরীক্ষা হবে আজ।
ইয়ানসেন-রাবাদার পর নরটিয়া
পাওয়ার প্লে শেষে সপ্তম ওভার করতে আসেন আনরিখ নরটিয়া এবং সাথে সাথেই দলের অন্যান্য বোলারদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।
আযমাতউল্লাহ ওমরযাই দৃশ্যত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা বোলিং তিনি আক্রমণ করবেন। নরটিয়ার তৃতীয় বলে তিনি ক্রিজ থেকে বেরিয়ে লং অফের উপর দিয়ে বাউন্ডারি পার করার চেষ্টা করেন – কিন্তু বল নেমে আসে বাউন্ডারি পাহারাদার ট্রিস্টান স্টাবস-এর হাতে। প্যাভিলিয়নমুখী মিছিলে যোগ দিলেন ওমরযাই। আফগানিস্তান তখন ৬ উইকেট হারিয়ে তুলেছে ২৮ রান।
মাঠে নামলেন রশিদ খান, কাঁধে তার পুরো জাতির আশা-ভরসা। কিন্তু ওপর প্রান্তে উইকেটের পতন তিনি থামাতে পারেন নি।
ম্যাচের দশম ওভারে হাত ঘুরাতে আসেন বাঁ-হাতি স্পিনার তাব্রেইয শামসি। প্রথম বল চলে গেল বাউন্ডারিতে। এর পরেই স্পিনের মুখে ব্যাটারদের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। শামসি এক ওভারে করিম জানাত এবং নুর আহমেদ দুজনকেই এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন।
আফগানিস্তানের আশার শেষ আলো নিভে যায় পরের ওভারে যখন নরটিয়া রশিদ খানের অফ স্টাম্প উপড়ে ফেলেন।
শামসি তার তৃতীয় উইকেট তুলে নেন ম্যাচের ১২তম ওভারে – এবার নাভিন-উল হক পা দিলেন এলবিডাব্লিউর ফাঁদে।
আফগানিস্তানের ইনিংস শেষ হল ১১.৫ ওভারে, ৫৬ রানে আল-আউট। টি২০ ফরম্যাটে এটাই আফগানিস্তানের সর্ব নিম্ন স্কোর।
এখন প্রশ্ন হল, আফগানিস্তানের বোলিং আক্রমণ এই ক্ষুদ্র স্কোর কীভাবে ডিফেন্ড করবে? সবার দৃষ্টি দুর্ধর্ষ পেস বোলার নাভিনউল হক আর ফাজালহক ফারুকির উপর – এবং রাশিদ খানের চতুর লেগ-স্পিনের দিকে।
'চোকার' আর না
সবার মনে ছিল আরেকটি কথা – ‘ চোকার’ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্নাম। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা স্নায়ুর চাপ সামলাতে পারে না। দক্ষিণ আফ্রিকা কি পারবে তাদের মানসিক দুর্বলতার দুর্নাম ঘোচাতে?
নাভিন-উল হকের প্রথম ওভারে ছিল গতি, বাউন্স এবং মুভমেন্ট। কিন্তু ডি কক আর হেন্ড্রিক্স উইকেট টিকিয়ে রাখে। ফারুকির প্রথম বল ডি কক পাঠালেন বাউন্ডারিতে। কিন্তু পঞ্চম বলে ডি ককের ব্যাট এবং প্যাডের মাঝে দিয়ে ঢুকে বল স্টাম্প তছনছ করে দেয়।
ডি ককের বিদায়ের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে বিপর্যয় নেমে আসে নি – যা হয়েছিল আফগানিস্তানের ইনিংসে, গুরবায আউট হওয়ার পর। দুই পেসারের আক্রমণাত্মক বোলিং-এর মুখে ক্যাপ্টেন এইডেন মারক্রাম আর হেন্ডিক্স মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজেদের উইকেট রক্ষা করেন এবং সুযোগ বুঝে বাউন্ডারি হাঁকান।
রান করার সুযোগ প্রায় প্রতি ওভারেই আসতে থাকে এবং এই জুটি তাদের প্রথম ৩০ বলে ৩০ রান তুলে নেয়।
ত্রিনিদাদের এই মাঠের উইকেট মোটেই ব্যাটিং-বান্ধব ছিল না। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটারদের কোন তাড়াহুড়া ছিল না। বিশেষ করে মাক্রাম নিখুঁত টাইমিং দিয়ে প্রতিটি বল মেপে খেলে দলকে সহজেই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যান।
এই টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনাল পর্যায়ে যে চারটি টিম পৌঁছেছে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার আছে ১০০ শতাংশ জয়ের রেকর্ড – প্রথম পর্বে চারটি আর সুপার ৮ পর্বে তিনটি। এখন সেমি ফাইনাল পার করে দিয়ে প্রোটিয়াস দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে।