সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডিন্সের আরনস ভেল মাঠে স্থানীয় সময় সোমবার (২৪ জুন) রাত গড়িয়ে মঙ্গলবার ভোরে আফগানিস্তান বাংলাদেশকে ৮ রানে হারিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন পাতা যোগ করে।
আইসিসি টি২০ বিশ্বকাপের সুপার ৮ পর্বের শেষ খেলায় আফগানিস্তানের এই জয়ের অর্থ হল, বুধবার রাতে ত্রিনিদাদের ব্রায়ান লারা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি মাঠের প্রথম সেমি ফাইনালে তারাই হবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিপক্ষ। বাদ পড়লো অস্ট্রেলিয়া।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আফগানিস্তান বাংলাদেশের তুখোড় বোলিং-এর মুখে তাদের ২০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ১১৫ তুলতে সক্ষম হয়। জবাবে বাংলাদেশের ওভার সংখ্যা বৃষ্টির কারণে একটি কমিয়ে দেয়া হয় আর লক্ষ্য মাত্রা কমিয়ে ১১৪ করা হয়। কিন্তু তারা ১৭.৫ ওভারে ১০৫ রান করে সবাই আউট হয়ে যায়।
তবে এই ম্যাচটি কোন পর্যায়েই মনে হয়নি দু’দলের কেউ নিশ্চিত ভাবে জিতবে। প্রতিযোগিতা হয়েছে প্রতিটি বলে। আফগানিস্তানের নায়ক নিঃসন্দেহে ছিলেন দলের অধিনায়ক রশিদ খান যিনি তার ৪ ওভারে ২৩ রানে ৪ উইকেট দখল করেন, আর নাভিনুল হক যিনি বাংলাদেশের শেষ দুই উইকেট সহ ২৬ রানে ৪ উইকেট তুলে নেন।
বাংলাদেশের উদ্বোধনী ব্যাটার লিটন দাস ৫৪ রানে অপরাজিত থাকেন – টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় উদ্বোধনী ব্যাটার যিনি ইনিংস শেষে অপরাজিত ছিলেন।
বোলারদের রাজত্ব
ইনিংসের শুরুতে আফগানিস্তানের রহমানউল্লাহ গুরবায এবং ইব্রাহিম জাদ্রান প্রথম উইকেটে তাদের নিয়ম মাফিক ৫০ রানের জুটি বাঁধেন। কিন্তু অন্যান্য সময়ের সাথে পার্থক্য ছিল যে, এই দুই তুখোড় ব্যাটারকে বাংলাদেশের বোলাররা কোণঠাসা করে রেখেছিল। তাদের ব্যাট থেকে রান আসছিল খুবই ধীর গতিতে।
প্রথম উইকেটের পতন হয় ১১তম ওভারে, যখন আফগানিস্তানের রান মাত্র ৫৯। অর্থাৎ ম্যাচের অর্ধেকের বেশি চলে যাবার পরও তাদের রান ছিল ওভারে ছয়-এর কম। জাদ্রান ২৯ বলে ১৮ রান করে আউট হন।
অপর উদ্বোধনী ব্যাটার গুরবায ৫৫ বল খেলে ৪৩ রান করে বিদায় নেন। মোহাম্মাদ নবী, গুলবাদিন নাইব এবং আজমাতউল্লাহ ওমারযাই অল্প রান যোগ করে প্যাভিলিয়নে ফেরত যান।
ইনিংসের শেষ প্রান্তে অধিনায়ক রশিদ খানের কিছু বেপরোয়া হিটিং আফগানিস্তানের স্কোর ১১৫ তে নিয়ে যায়। খান কতটা অধৈর্য হয়েছিলেন তা বোঝা গেল যখন জানাত করিম দ্বিতীয় রান নিতে অস্বীকার করলে তার ক্যাপ্টেন স্ট্রাইক না পেয়ে করিমের দিকে ব্যাট ছুঁড়ে মারেন।
আফগানিস্তানের ব্যাটিং সমস্যার পেছনে কারণ ছিল মূলত বাংলাদেশের বোলিং। অধিনায়ক নাজমুল হাসান শান্ত পাঁচজন বোলার ব্যবহার করেন এবং তানজিম হাসান সাকিব ছাড়া তাদের কেউ ওভারে ৬.৫০ রানের বেশি দেয় নি। তাসকিন আহমেদ (১-১২), মুস্তাফিজুর রহমান (১-১৭), রিশাদ হোসেন (৩-২৬) এবং সাকিব আল-হাসান (০-১৯) আগানিস্তানের ব্যাটিংকে পুরো ইনিংস আটকে রাখতে সক্ষম হয়।
সেমি ফাইনালের হাতছানি
বাংলাদেশ যখন ব্যাট করতে নামে তখন তাদের মাথায় ২০ ওভার নয়, ছিল ১২.১ ওভারে ১১৬ রানের লক্ষ্য। কারণ, ১২.১ ওভারে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছালে বাংলাদেশ রান রেটের সুবাদে সেমি ফাইনালে পৌঁছে যাবে।
নাভিনউল হকের প্রথম ওভার থেকে ১৩ রান আসে – যার মধ্যে ১১ আসে লিটন দাসের ব্যাট থেকে। তবে এই বিশ্বকাপের অন্যান্য খেলার মত বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয় বেশি দূরে ছিল না।
দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ওভারের মধ্যে মাত্র সাত রান যোগ করে তিনটি উইকেটের পতন হয় – তানজিদ হাসান (০), নাজমুল হাসান শান্ত (৫) আর সাকিব আল-হাসান (০)।
টিমে ফেরত এসে সৌম্য সরকার তার স্থানের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে, কিন্তু কোন সময় ক্রিজে তাকে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট করতে দেখা যায় নি। দশ বলে ১০ রান করে সরকার রশিদ খানের বলে বোল্ড হলে বাংলাদেশের সেমি ফাইনালের সম্ভাবনা দুরহ মনে হতে শুরু করে।
কিন্তু উদ্বোধনী ব্যাটার – এবং সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে টেকনিক্যালি পারদর্শী প্লেয়ার – লিটন দাস তখনও ক্রিজে। সরকারের বিদায়ের পর তার সাথে যোগ দেন তওহিদ হৃদয়। তিনি রান রেট বাড়ানোর লক্ষ্যে বোলারদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু নয় বলে ১৪ রান তোলার পর রশিদ খানের পাতা ফাঁদে পা দেন।
রশিদ খানের ঘূর্ণিঝড়
খান তার লেগ-স্পিন দিয়ে বাংলাদেশের মিডল এবং লোয়ার অর্ডার ব্যাটিং পুরোপুরই বেঁধে ফেলেন। খান তার তৃতীয় ওভারে মাহমুদউল্লাহ আর রিশাদ হোসেনের উইকেট তুলে নিলে বাংলাদেশের স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় ৭ উইকেট হারিয়ে ৮০ রান। অর্থাৎ সেমি ফাইনালে খেলার সুযোগ সেখানেই শেষ।
এর পর বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল শুধু মর্যাদার জন্য – আর অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ব্যাটিং। কারণ, বাংলাদেশ কোন ভাবে জিতলে অস্ট্রেলিয়া যাবে সেমি ফাইনালে।
লিটন দাস ১৬তম ওভারে নুর আহমেদের দ্বিতীয় বল বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে তাঁর অর্ধশতক সম্পন্ন করেন। রশিদ খানের স্পিন ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ৪১ বলে ৫০ রান সংগ্রহ করা কোন ছোট অর্জন ছিল না।
আট বল বাকি থাকতে তাসকিন আহমেদ নাভিনউল হকের বলে বোল্ড হন – বাংলাদেশের তখন প্রয়োজন ৯ রান, কিন্তু হাতে মাত্র এক উইকেট। নতুন ব্যাটার মুস্তাফিজুর রহমান ক্রিজে।
‘শাসরুদ্ধকর’ শব্দটি হয়তো এধরনের ম্যাচের জন্য আবিষ্কার করা হয়েছিল!
ঠিক তখন বৃষ্টি হস্তক্ষেপ করে, খেলা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে। অল্প সময় পরে আম্পায়াররা মাঠে ফিরলে নাভিনুল হক তার পরের বলেই ফিজকে এলবিদউব্লিউ ফাঁদে ফেলেন।