অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

আমার মনে হয় না অর্থমন্ত্রী সরকারের নীতি অনুযায়ী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন– শওকত হোসেন মাসুম


শওকত হোসেন মাসুম
শওকত হোসেন মাসুম

বাংলাদেশে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। জাতীয় সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা চলমান। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো– এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য অংশীজনের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

বাজেটের সার্বিক বিষয় নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলার সাথে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতি-বিষয়ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম।

তিনি মনে করেন, এই বাজেটে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো দিকনির্দেশিকা নেই।

বাজেটে অর্থমন্ত্রী যে নথিপত্র এবং হিসাব দিয়েছেন, সেখানে একটির সাথে আরেকটির সংখ্যা মিলছে না বলে উল্লেখ করে জনাব মাসুম বলেন, "যে কারণে একটা গোঁজামিল আছে বলে আমার মনে হয়। যেমন ধরুন– সরকার এবার বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের যে চিত্রটা দিয়েছে, সেখানে পরিসংখ্যানের মধ্যে আমি বেশ কিছু গোঁজামিল দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, কর্মসংস্থানের তেমন হিসাব ভালো করে আমরা পাই না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কতটুকু কর্মসংস্থান হয়েছে, তার একটি সুন্দর হিসাব থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের এ কর্মসংস্থানের সঠিক তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে আমরা কিন্তু জানি না। আনুমানিক একটা হিসাব ধরে নেই যে যত বিনিয়োগ বাড়বে তত কর্মসংস্থান বাড়বে।"

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল্লাহ আমান।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে ইতিবাচক দুটি দিক কোনগুলো?

শওকত হোসেন: আসলে এককথায় বলাটা অনেক কঠিন। কারণ, একটা বাজেট সব সময় খুব ভালো হয় না, খুব খারাপও হয় না। এটা মাঝামাঝি অবস্থানে থাকতে হয়। তবে অর্থনীতির সংকট যখন তীব্র থাকে, তখন বাজেটের ওপর মানুষের নজর বেশি থাকে, বিশেষ করে প্রত্যাশার নজর থাকে। সেই সংকট থেকে উত্তরণের যে জায়গাটা, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, তাহলে দেখতে পাই যে এই বাজেট আমাদের খুব বেশি ভরসা দিতে পারছে না। কারণ, অর্থনীতির যে সংকটটা কোভিডের পর থেকে শুরু হয়েছে এবং ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরপরই সেটা অত্যন্ত তীব্র হয়েছে, তখন কিন্তু বেশির ভাগ দেশই সংকটে পড়েছিল। নানান পদ্ধতি অবলম্বন করে অনেক দেশই উত্তরণের পথে গেছে। আমরা পারিনি বলেই সংকটের মধ্যে আছি। আমাদের আশা ছিল, এই বাজেট পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য দিকনির্দেশিকা হবে। তবে আসলে তা হয়নি। যে তীব্র সংকটের মধ্যে আছি, আমার মনে হয়, এত সহজে এই সমস্যা থেকে বের হতে পারব না।

ইতিবাচক দিক বলতে, প্রত্যেক অর্থমন্ত্রী বাজেটটা বড় দেখানোর একরকম প্রতিযোগিতায় থাকেন। কে কত বড় বাজেট দিলেন, সেটা দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এদিকটাতে অত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এটাকে আমি একটা ইতিবাচক দিক বলব কিন্তু পুরো ক্রেডিটটা আমি অর্থমন্ত্রীকে দেব না। কারণ, এখানে আইএমএফের একটা ভূমিকা আছে, আমরা আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছি। আমরা জানি যে তারা বাজেটের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে যেতে চান না। তো এটা একটা ইতিবাচক দিক বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয় ইতিবাচক দিকটা হচ্ছে যে আমাদের ট্যাক্স জিডিপির রেশিও অনেক কম। তার পরেও ট্যাক্স জিডিপি বাড়ানোর একটা প্রবণতা আছে। যেহেতু চেষ্টা করা হচ্ছে, সুতরাং এটি একটি ইতিবাচক দিক বলে আমি মনে করি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখার; যা মোট বাজেটের ১৪.২৪ শতাংশ। সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধই একক খাত হিসেবে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের সবচেয়ে বড় খাত। এর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে? এ খাতে খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন?

শওকত হোসেন: বিষয়টা খুব জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের ব্যয়ের খাতটা ক্রমাগত বাড়িয়ে ফেলছি। আয় যা-ই হোক না কেন, আমরা ব্যয় বাড়াচ্ছি। সেখানে বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই ব্যয় অনেক বাড়িয়েছি। ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা, অদক্ষতা কমানোর সংকল্প ছিল কিন্তু আমরা খুব একটা সফল হইনি। এই ব্যয় কমানোর জন্য আমাদের অনেক ঋণ করতে হয়েছে। এবং এই ঋণ বাবদ এখন সেটি পরিশোধ করা লাগছে। দুই বছর আগেও আমরা দেখেছি যে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছিল। সরকারের ভেতরেও আবার দুটি পক্ষ ছিল। একটি পক্ষ মনে করত যে সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণটা দেখানো বেশি জরুরি। অর্থাৎ মুনাফা বেশি দেখানো, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষ এর ওপর নির্ভর করে চলতে পারে। আবার আরেক দল মনে করে যে সঞ্চয়পত্রের যত বেশি সুদহার থাকবে, তত মানুষ ব্যাংকবিমুখী হবে। এদিকে আমাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধের বোঝাটাও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও গোছানো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। এখানে আসলে অনেকগুলো খাত আছে। আমি আগের প্রশ্নের উত্তরের ধারাবাহিকতায় আসি। আমরা স্বাধীনতার পর একরকম বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিলাম। আমরা এখন বলি যে, বাণিজ্যনির্ভর দেশ। আমরা বাণিজ্য নিয়ে দরকষাকষি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব ঋণের চাইতে। কিন্তু আমরা ঋণ থেকে পুরোপুরি যে বের হয়ে আসতে পেরেছি, তা না। আরও অনেক জায়গা আছে, যেখানে আমাদের বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হয়। বহুজাতিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, যেমন– বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে শুরু করে জাপান, সেখান থেকে যদি আমরা ঋণ নেই, সেগুলোর সুদের হার অনেক কম। সার্ভিস চার্জও কম দিতে হয়। এ ছাড়া একটা দিক দেখুন, খোলাখুলিভাবে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। ঋণ যে পাচ্ছি না, সে রকমও না। এভাবে সরকারের ঋণ নেওয়া যত বেশি বাড়বে, মূল্যস্ফীতি ততই বাড়বে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তার ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নিজেই যদি এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়, এর কী ধরনের প্রভাব দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর পড়বে?

শওকত হোসেন: এখানে খুবই মজার ব্যাপার হচ্ছে যে বাজেট মন্ত্রী বাজেটের যে নথিপত্র এবং হিসাব দিয়েছেন, সেখানে একটির সাথে আরেকটির সংখ্যা মিলছে না। যে কারণে একটা গোঁজামিল আছে বলে আমার মনে হয়। যেমন ধরুন– সরকার এবার বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের যে চিত্রটা দিয়েছে, সেখানে পরিসংখ্যানের মধ্যে আমি বেশ কিছু গোঁজামিল দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, কর্মসংস্থানের তেমন হিসাব ভালো করে আমরা পাই না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কতটুকু কর্মসংস্থান হয়েছে, তার একটি সুন্দর হিসাব থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের এ কর্মসংস্থানের সঠিক তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে আমরা কিন্তু জানি না। আনুমানিক একটা হিসাব ধরে নেই যে যত বিনিয়োগ বাড়বে, তত কর্মসংস্থান বাড়বে। এবং আপনি যদি মনে করেন যে অর্থবছরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে সে অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী, আগের বছরের অর্থমন্ত্রী বেসরকারি বিনিয়োগের হিসাব দিলেন যে বেসরকারি খাতগুলোতে বিনিয়োগ হবে প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ। এবং সেটা আগের বছর ছিল ২৪.৮১ শতাংশ। আপনি দেখেন গত ১০ বা ২০ বছরে আমরা অনেক কষ্টের মাধ্যমে একটু একটু করে ২৩ থেকে ২৪ শতাংশে নিয়ে এসেছি। আগের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি এক বছরে ৪ শতাংশ জিডিপি বাড়াবেন। এক বছরে জিডিপি ৪ শতাংশ বাড়ানো– এটা মুখের কথা না। কিন্তু এখন দেখি আশানুরূপ থেকে আরও কম হয়েছে। এমনকি এই বিনিয়োগ ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়েও কম। এর প্রভাব কিন্তু আমরা দেখছি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে যেটা ৫.৮২ শতাংশ হয়েছে। এটা সরকারের হিসাব বলছে। নতুন অর্থবছরে আবারও বিনিয়োগের হিসাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?

শওকত হোসেন: বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে? আমি যে হিসাবটা দেব, তার তো একটা মিনিমাম প্রত্যাশা থাকা লাগবে। আবার এই বাজেট পরিসংখ্যানে লক্ষ্য করুন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হবে ৯ শতাংশ, যেটা আগের বছর ছিল ১০%। তার আগের বছর ছিল আরও বেশি। সুতরাং আমার মনে হয় না অর্থমন্ত্রী– তিনি সরকারের নীতি অনুযায়ী সঠিকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করে বলছেন, বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশ, কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটে ১৫ শতাংশ কর দিলেই যেহেতু চলবে, এটি তাই কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করা হবে। নৈতিকতার প্রশ্নটি বাদ রেখেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ কতটা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আপনি মনে করেন?

শওকত হোসেন: ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এবং এখনও সেটি চলছে। ১৯৭৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪৬ বছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমরা যদি পরিসংখ্যান দেখি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকাও সাদা হয়নি। এবং এই ৫০ হাজার কোটি টাকার ভেতরে আমি যতটুকু জানি ৪৫ থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে মাত্র দুটি অর্থবছরে। একটি হচ্ছে ২০০৭-০৮ অর্থবছর; সেনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তখন সেই সরকারের অধীনে কড়াকড়ি ছিল; যার দরুন বড় বড় ব্যক্তিবর্গ কালো টাকা সাদা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা; যার মধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকা ছিল নগদ এবং বাকিগুলো ছিল ফ্ল্যাট বা জমিজমা থেকে।

যখন কোভিড ছিল, তখন টাকা পাচারের কোনো সুযোগ ছিল না। কোভিড শেষ হওয়ার পরে যখন দেশ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসে, তখন সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো টাকা সাদা হয়নি। বিভিন্ন খাত রয়েছে অনুৎপাদনশীল খাত; যেগুলোতে বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল কিন্তু বিনিয়োগ করা হয়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিন্তু কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়। এর মধ্যে গ্রিস অন্যতম। একটা বছর ধরে তারা খুঁজে বের করেছে এবং কার কার কাছে সম্ভাব্য কালো টাকা থাকতে পারে সেটাও বের করেছে, নথিপত্রগুলো পর্যালোচনা করেছে, পর্যালোচনা করার পরে মিলিয়ে দেখেছে যে ওই ব্যক্তির সাথে তার জীবনযাত্রা এবং আয়ের হিসাব মিলছে না। তখন তারা নোটিশ দিয়ে তাদের বাধ্য করেছে কালো টাকা সাদা করার জন্য। আর আমাদের দেশে বাজেটের ১৫ দিন আগে হঠাৎ করে কারও মনে হলো এবার তো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এভাবে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া বাজেটের মধ্যে একটি প্যারা সংযুক্ত করা মোটেও ভালো কিছু নয়। তার পরও কেন সরকার কাদের স্বার্থে সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে, সেটার কিন্তু পরিষ্কার ব্যাখ্যা তারা দেয় না। আমার মনে হয়, সরকার কারও সাথে আপস করে এ বিষয়ে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: মূল্যস্ফীতি গত দু’বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপর। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এ জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো ও কৃচ্ছসাধনের ওপর মন্ত্রী জোর দিয়েছেন? এগুলো বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের কতটা রয়েছে? মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

শওকত হোসেন: একটা বিষয় আগে আমাদের জানা দরকার যে মূল্যস্ফীতি কমানোর দায়িত্বটা আসলে কার। এ বিষয়ে বাংলাদেশে একটা সমাধান হওয়া দরকার। আমরা যদি অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ধরি, ইনফ্লেশন টার্গেটিং নামে একটা কথা আছে যে তারা ইনফ্লেশন কত পার্সেন্টে কমিয়ে আনবে। আপনি যদি তাদের এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে তারা সঠিক তথ্য-উপাত্ত সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। পরিকল্পনা করার আগে আমাদের দেশে ঠিক করা উচিত– কে মূল্যস্ফীতির দায়িত্বটা নেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া উচিত এবং তারা এ বিষয়টি সঠিকভাবে পালন করতে পারছে কিনা, সেটি পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ করার জন্য সঠিক পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখা উচিত।

অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে খোলা চিঠি দেয়, যেটা সরকারের পক্ষ থেকে আসে এবং তিনি যদি তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারেন এবং টার্গেটিং বাজেটকে সফল করতে না পারেন, তবে বাজেটে নেক্সট টার্গেট সেটা সফল করার কথা বলে জনগণকে আশ্বাস দিতে পারেন। তখন সেই খোলা চিঠিটি প্রকাশ্যে প্রকাশ করা হয়।

আমি মনে করি, আমাদের দেশে বাজেটের মাধ্যমে প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাবটি পরিষ্কারভাবে আসা উচিত। তারপরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা করা উচিত তারা কী চায়। তখন সেটাকে একটা সমন্বয় করা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সরবরাহ ও চাহিদা ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমরা এখনও পারিনি। তার একটি বড় কারণ, নজরদারির অভাব। ২০১৮-১৯ সালে যখন মুদ্রা অবমূল্যায়ন হয়, তখন আমরা সেটা করিনি। এমন সময়ে করলাম যখন আমাদের সংকটকাল। এবং এখন আমরা এমনভাবে বাধ্য হয়েছি, যার প্রভাব আমাদের পুরো অর্থনীতির ওপর পড়েছে। ৮৬ টাকার ডলার ১১৭ টাকায় এসেছে। এবং এটার কারণে আমরা রিজার্ভ আরও অর্ধেকের বেশি কমিয়ে নিচ্ছি। সেটার প্রভাবে আমদানি কমাতে যেয়ে আমরা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে ফেলেছি। সারা বিশ্ব যখন সুদের হার কমিয়েছিল, তখন আমরা সেটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কেন এই অব্যবস্থাপনা?

সুদের হারের ওপর সব সময় বিনিয়োগ নির্ভর করে না। সুতরাং এ রকম ভুল নীতির ওপর নির্ভর না করে আমার মনে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুরোপুরি ক্ষমতা দেওয়া উচিত। তারা কী করবে না করবে, কীভাবে পরিকল্পনা করবে– সেটা তারা বুঝবে এবং সরকারকে জানাবে সরকারের কী করা উচিত।

ভয়েস অফ আমেরিকা: জনপ্রশাসন খাতে খরচ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা, যা শীর্ষ পাঁচ ব্যয় বরাদ্দ খাতের একটি। অথচ আমরা প্রতিবছরই দেখি বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। যার জন্য জনপ্রশাসনের অদক্ষতাকে সমালোচকরা একটি প্রধান কারণ বলে মনে করে থাকেন। বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি না করে জনপ্রশাসন খাতে এ বিপুল বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক? বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

শওকত হোসেন: আমি আগেই বলেছি আমরা কোনো না কোনোভাবে সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছি। এবং এফবিসিসিআই-ও সরকারি ব্যয় কমানোর কথা বলছে। এত বড় ঋণ আসলে সরকারের নিজের নিয়ন্ত্রণেও নেই যে এত সহজে কমিয়ে ফেলবে। ধরুন, আমি একটা উদাহরণ দেই– পানি সরবরাহের দায়িত্বে আছে ওয়াসা। ওয়াসা পানি সরবরাহ করবে– সেই পানি আমরা খাব। কিন্তু আমাদের পানি কিনে খেতে হয়। এবার পানি বিশুদ্ধকরণে বাজেটটা বাড়ানো হচ্ছে। আমরা দেখছি যে একদিকে আমরা পানি কিনে খাচ্ছি, সেই পানি যখন আবার শুদ্ধ করতে যাব, সেখানেও বাড়তি বিল করতে হচ্ছে এত বেশি ব্যয় করে।

দুর্নীতির ক্ষেত্রে যদি ধরি, লাইসেন্স বাবদ যে খরচ হয় সে খরচটা ব্যবসায়ী তাঁর ব্যবসার মধ্যে যোগ করে ফেলেন। এবং এভাবে খরচের চাপ বেড়েই চলেছে। সুতরাং জনপ্রশাসনের এই বিষয়টা আসলে ভাবার একটি বিষয়।

সরকার তো এখন বাইরের কারও থেকে পরামর্শ নেওয়ার সেই সুযোগটা রাখেনি। কিন্তু আপনি দেখেন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কিন্তু বাইরের সবার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে একটা কাজের সিদ্ধান্ত তৈরি করার অধ্যায় আছে। অনেক কিছু বলার পর এখন বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে কয়েকজনকে যুক্ত করেছে।

আগে একটা খোলামেলা আলোচনা করার মতো জায়গা ছিল কিন্তু এখন সেটা নেই। এবং আপনি যদি দেখেন এই বাংলাদেশে একবার সরকারি ব্যয় নিয়ে পর্যালোচনা মিটিং করা হয়েছিল। এম হাফিজ উদ্দিন সাহেবকে প্রধান করে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমি মনে করি, অবিলম্বে আরও একটি সরকারি ব্যয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। শুধু ব্যয় সংস্কার কমিটি গঠন করা নিয়ে যেভাবে বলছি একই সাথে সরকারি ব্যয় নিয়ে পর্যালোচনা কমিটি গঠন করাও সমান জরুরি। তারা পর্যালোচনা করে দেখুন কোথায় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে। অহেতুক ব্যয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হচ্ছে কিনা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয় তাদের ওপরই করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে, বলে সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

শওকত হোসেন: দেখুন, সরকার যেখান থেকে রাজস্ব আদায় সহজ বলে মনে করে, সেখান থেকেই বারবার রাজস্ব আদায় করে। যেমন ধরুন– সিগারেট। সিগারেট আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তারপরও কিন্তু বছর বছর এখান থেকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আদায় করা হয়। যারা কর ফাঁকি দেন, ভ্যাট ফাঁকি দেন– তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত এবং এই সমস্যা নির্মূলের জন্য যথাযথ রাজনৈতিক অবস্থান গঠন করা জরুরি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সব ক্ষেত্রেই অভিন্ন ভ্যাট হার নির্ধারণ করাটা কতটা কার্যকর হবে? এবারেই কি এটি করা উচিত ছিল? কত দিনের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জনের টার্গেট নেওয়া উচিত?

শওকত হোসেন: এটা নিয়ে আসলে বেশি কিছু বলার নেই। এখানে আসলে হারের কথাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে কথা হচ্ছে দক্ষতার প্রতি আমরা যত বেশি গুরুত্ব দিতে পারব, তত বেশি সমস্যা নির্মূলের পথে আমরা এগোব। তাছাড়া কবে নাগাদ অর্জন হবে, এটা বলা মুশকিল। বললাম না এটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার, তাদের রাজনৈতিক নীতি যতদিন পর্যন্ত ঠিক না হবে। এটা সম্পূর্ণই তাদের ওপরে যে তারা কতটুকু সচেষ্ট এই সমস্যা নির্মূলের ক্ষেত্রে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না। কেন? এবারের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? এর তিনটি ইতিবাচক দিক বলবেন? প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন কোন দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত; যা এবারের বাজেটে সেভাবে দেওয়া হয়নি।

শওকত হোসেন: এখানে খুব বেশি বলার কিছু নেই এজন্য যে, ৪২ হাজার ১৪ কোটি টাকা এখানে দেওয়া হয়েছে; যা আগের বছরে তুলনায় ৪ হাজার ২৯০ কোটি টাকা বেশি। সুতরাং অস্বাভাবিকভাবে যে বাড়ানো হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। তবে এখানে আরেকটি কথা আছে। আমরা যদি দাবি করতে পারি যে কোথায় কতটুকু বাড়ানো হয়েছে। এই বরাদ্দ আসলে যুক্তিযুক্ত কিনা, কোথায় খরচ হচ্ছে, আসলে কোন জায়গায় খরচ হচ্ছে– এটা নিয়ে সংসদের বাইরে বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে আলোচনা হবে। আলোচনা যত হবে, তত বেশি স্বচ্ছতা তৈরি হবে। বেশি খোলামেলা আলোচনা হলে জবাবদিহিতার একটা জায়গা তৈরি হয়।

XS
SM
MD
LG