নভেম্বরের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস জয়ের প্রচেষ্টা যদি সফল হয় তাহলে তিনি যাদের রাজনৈতিক শত্রু মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ব্যবহার করার অভিপ্রায়ের কথা তিনি ক্রমান্বয়েই স্পষ্ট করে বলছেন।
ট্রাম্পের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিশ্রুতি নতুন নয়। তিনি ২০১৫ সালে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার পর থেকেই তার সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ কররার জন্য অভিযোগের রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন।
গত বছর বার্ষিক কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, “আমি আপনাদের যোদ্ধা। আমি আপনাদের ন্যায় বিচার। আর যারা নির্যাতন এবং বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে, আমি আপনাদের প্রতিশোধ।”
তবে, গত মাসে নিউইয়র্কের আদালতে ট্রাম্প ৩৪টি ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি তার সমর্থকদের পক্ষে করা হচ্ছে না, বরং তার নিজের ব্যক্তিগত আইনি জটিলতার প্রতিক্রিয়া হিসাবেই তিনি করছেন।
মামলার রায় বেশ কিছুদিন আগে দেয়া হলেও, তাঁর সাজা এখনো ঘোষণা করা হয় নি।
নির্যাতনের অভিযোগ
সাবেক প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন যে দেশব্যাপী বিভিন্ন বিচার বিভাগে যে তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি অভিযোগ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ব্যাপক ষড়যন্ত্রের ফসল, যাতে তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী না হতে পারেন।
তিনি এইসব বিচারের দায়ভার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর দিয়েছেন অথবা 'আড়ালে থাকা গোপন ষড়যন্ত্রকারীদের একটি ছোট দলকে', যারা বাইডেনকে প্রভাবিত করছেন বলেও তিনি দাবি করেন।
ট্রাম্প দাবী করেন, এ’কারণেই সুযোগ পেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে ঐসব ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে।
গত সপ্তাহে ফক্স নিউজের উপস্থাপক শন হ্যানিটিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, “দেখুন এই নির্বাচন যখন শেষ হবে, তখন তারা যে কাজ করেছে তার ভিত্তিতে আমার তাদেরকে ধরার পূর্ণ অধিকার থাকবে এবং কাজটি তখন সহজ হবে কারণ এটা হচ্ছে জো বাইডেন।”
গত সপ্তাহের শেষের দিকে মনোবিজ্ঞানী ফিল ম্যাকগ্র যখন ট্রাম্পের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন তখন এ বিষয়টি আবার সামনে চলে আসে।
ম্যাকগ্র, একজন টেলিভিশন উপস্থাপক যিনি ডক্টর ফিল নামে বহুল পরিচিত, তিনি ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা তার অন্যান্য রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
“প্রতিশোধ নিতে অবশ্যই সময় সময় লাগে, আমি সেটাই বলব,” জবাবে ট্রাম্প বলেন। “এবং প্রতিশোধ কখনও কখনও ন্যায়সঙ্গত হতে পারে ফিল, আমাকে সত্য কথা বলতে হবে। তুমি জানো, কখনও কখনও এটি হতে পারে।”
মিত্ররা ট্রাম্পের ডাকের প্রতিধ্বনি দিচ্ছে
ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হলে তার অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি হবে তার আদেশ পালনে ইচ্ছুক অনুগতদের দিয়েই প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করবেন। হোয়াইট হাউসে চার বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি প্রায়শই হতাশ হয়েছেন, কারণ কর্মকর্তারা দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ভাঙ্গতে পারে বা আইনের পরিপন্থী হতে পারে ভেবে তাঁর আদেশ মানতে দ্বিধা করতেন।
ইতোমধ্যে ট্রাম্পের কিছু সহযোগী যাদের দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনে হোয়াইট হাউসের পদের জন্য বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তারা টাম্পের কথার প্রতিধ্বনি করছেন। তারা রিপাবলিকান কর্মকর্তাদেরকে সাবেক প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক শত্রুদের টার্গেট করার জন্য সর্বময় ক্ষমতা ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে।
সম্প্রতি ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের সাবেক হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার যিনি সম্ভবত ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার প্রশাসনে থাকবেন তিনি বলেন, “মার্কসবাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা এবং এইসব কমিউনিস্টদের পরাজিত করতে রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রতিটি ক্ষেত্র এখনই ব্যবহার করতে হবে।”
“প্রত্যেক রিপাবলিকান অ্যাটর্নি জেনারেল কি ভোট জালিয়াতির তদন্ত শুরু করছেন, এই মুহুর্ত্বে?” তিনি প্রশ্ন করেন।
তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি হাউস কমিটি যেটা রিপাবলিকানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তারা কি তাদের সমনজারি করার ক্ষমতা ব্যবহার করছে এই মুহুর্ত্বে? প্রত্যেক রিপাবলিকান ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি কি এখনই প্রয়োজনীয় সব তদন্ত শুরু করছেন?”
ট্রাম্পের সাবেক হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা স্টিভ ব্যাননও একইভাবে ডেমোক্র্যাটদের টার্গেট করার জন্য রিপাবলিকানদের আহ্বান জানিয়েছেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিলে কেবল এই জাতীয় প্রচার জোরদার করা হবে।
“এ বছরের ৫ নভেম্বর হবে জাজম্যান্ট ডে বা রায় ঘোষণার দিন” তার নিজের দৈনিক পডকাস্টের সাম্প্রতিক এক পর্বে নির্বাচনের দিনের কথা উল্লেখ করে ব্যানন একথা বলেন। “জবাবদিহিতা দিবস শুরু হবে ২০ জানুয়ারি বিকেলে, যখন ডনাল্ড জন ট্রাম্প কিং জেমস বাইবেল থেকে তার হাত সরিয়ে নেবেন এবং আমরা কাজ শুরু করবো।”
ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়া
বাইডেন প্রায়শই ট্রাম্পের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সমালোচনা করেছেন কিন্তু নিউইয়র্কে সাবেক প্রেসিডেন্ট যে সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সে সম্পর্কে বাইডেন তুলনামূলকভাবে খুব কমই বলেছেন।
তবে, সম্প্রতি এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট তার পূর্বসূরির সমালোচনা করে বলেন যে ট্রাম্প বিচার ব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করেন এবং তার বিরুদ্ধে যে রায় দেওয়া হয়েছে তা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
“আইনের শাসনকে ক্ষুণ্নকরা বন্ধ করুণ। প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাটো করে দেখা বন্ধ করুন”, বলেন বাইডেন। “ট্রাম্পের পুরো চেষ্টাই এমনই। তিনি একে খাটো করার চেষ্টা করছেন। দেখুন, তিনি ন্যায় বিচার পেয়েছেন। জুরিমণ্ডলী এমন ভাবে কথা বলেছেন যেমন তারা সব ক্ষেত্রে করে থাকে এবং একে সম্মান করা উচিত।
সপ্তাহান্তে মিশিগানে দেওয়া বক্তব্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস ট্রাম্প সম্পর্কে আরও বলেন, “ তিনি মিথ্যা প্রচার করেছেন যে আমাদের প্রশাসন এই মামলাটি নিয়ন্ত্রণ করছে, যখন সবাই জানে যে এটি একটি রাজ্যভিত্তিক বিচার ছিল। এবং তিনি বলেছেন যে তিনি তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ব্যবহার করবেন।”
“সোজা কথায়, ডনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন তিনি আইনের উর্দ্ধে," হ্যারিস বলেন। “এটার জন্য যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত।”
প্রেসিডেন্টের জন্য 'নজিরবিহীন'
ব্রাউন বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জেমস এ মোরনে ভিওএ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ট্রাম্প ফেডেরাল সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুদের নিপীড়ন করার যে অঙ্গিকার সরাসরি করেছেন,তা দেশের ইতিহাসে আর ঘটে নি।
“একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষে এ’ধরনের কথা বলা আসলেই নজিরবিহীন,” মোরনে বলেন। “এবং প্রকৃতপক্ষে, ঐতিহাসিক উদাহরণগুলো ঠিক উল্টো।”
মোরনে বলেন, এমনকি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর পরাজিত কনফেডারেট বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় নি।
প্রাক্তন কনফেডারেট প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিসকে গ্রেফতার করা হয় এবং দেশদ্রোহের মামলা করা হয়, কিন্তু তাঁর বিচার কখনো হয় নি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পরে প্রত্যাহার করা হয় এবং তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তাঁর নিজের জীবনে ফিরে যান।
মোরনে বলেন ট্রাম্পের বক্তৃতা বাজি বিশেষ করে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে, কারণ এগুলো বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সরকারি কর্মকর্তাদের এমন বার্তা দিচ্ছে যে, তাঁরা হয়তো ভাবতে পারেন যে ট্রাম্পের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হবে।