অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

গণতন্ত্রের সঙ্কটঃ নির্বাচনের বছরে যে কারণে ভোটারদের মেজাজ খারাপ


আর্জেন্টিনায় ছাত্ররা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই-এর নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। ফটোঃ ২৩ এপ্রিল, ২০২৪।
আর্জেন্টিনায় ছাত্ররা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই-এর নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। ফটোঃ ২৩ এপ্রিল, ২০২৪।

পূর্ব লন্ডনের একটি কমিউনিটি সেন্টারে প্রায় ২০জন পুরুষ তাদের নিয়মিত দুপুরের খাবারের আড্ডায় মিলিত হন। নানা রকমের কফি এবং চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে তারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ক্রমশ জনপ্রিয় একটি আলাপচারিতায় মগ্ন হলেনঃ তাদের সরকার নিয়ে অভিযোগ।

তারা দেশের নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করছেন – দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে।

“এটা এমন যে মনে হবে আপনারা দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ। আমাদের সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারছেন না আমরা কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, বলছেন ৬৫ বছর বয়সী ব্যারি স্ট্র্যাডলিং। “তারা কি মানুষের কথা জানতে চান? আমার তো মনে হয় না তারা তা করে।”

জাকার্তার একটি কফি শপে ৪৬ বছর বয়সী নি ওয়ায়ান সুরিয়াতিনি সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন, যেখানে ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্টের পুত্র দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং এটা রোধ করেতে বিরোধী দলগুলি তেমন একটা চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় নি।

“তাদের বিশ্বাস করা কঠিন কারণ তারা কেবলমাত্র তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। যতক্ষণ না তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন ততক্ষণ তারা অন্য সবকিছু ভুলে যাবে, ” সুরেয়াতিনি রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বলেন।

Sally Otto, owner of a downtown craft collective, speaks May 21, 2024, in Greeley, Colo.
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের গ্রিলির স্যালি অটো। ফটোঃ ২১ মে, ২০২৪।

এবং আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের গ্রিলিতে পরিপাট্যহীন একটি কারুপণ্যের দোকানের মালিক ৫৮ বছর বয়সী স্যালি অটো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ২০২০ সালে তিনি যে ব্যক্তিকে পরাজিত করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ভয়ে আছেন।

“আমি মনে করি আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে এসেছি। দু’জনই এক রকম, প্রার্থী নির্বাচন ভাল হয়নি,” অটো বলেন।

বিশ্বব্যাপী ভোটের উৎসব

এবছরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ভোট দিচ্ছে – এবং ভোটাদের মেজাজ একেবারে খারাপ। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আর্জেন্টিনা, একের পর এক নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার বিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক স্টিভেন লেভিটস্কির হিসাব অনুযায়ী, গত সপ্তাহান্তে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কেবল ল্যাটিন আমেরিকাতেই নেতারা ও তাদের দলগুলো টানা ২০টি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে।

“অনেক দিক থেকেই, আমরা আগে কখন এত ভাল ছিলাম না। কিন্তু তারপরও, মানুষ অন্ত্যন্ত অসন্তুষ্ট,” বলছেন ওয়াশিংটন ডিসির কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো ম্যাথিয়াস ম্যাথিজ বলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই ২০২৪ সালে চার বছর আগের বাইডেন বনাম ট্রাম্প লড়াই-এর পুনরাবৃত্তি নিয়ে সন্তুষ্ট না। ট্রাম্পের ফটোঃ ৯ জুন, ২০২৪। বাইডেনের ফটোঃ ৪ জুন, ২০২৪।
যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই ২০২৪ সালে চার বছর আগের বাইডেন বনাম ট্রাম্প লড়াই-এর পুনরাবৃত্তি নিয়ে সন্তুষ্ট না। ট্রাম্পের ফটোঃ ৯ জুন, ২০২৪। বাইডেনের ফটোঃ ৪ জুন, ২০২৪।

এই অসন্তুষ্টির কারণ অনেক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমস্যাকে বড় করে দেখানোর ক্ষমতা থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস মহামারী থেকে বেদনাদায়কভাবে সেরে ওঠা বা বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দিকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত।

রাজনীতির বিরুদ্ধে মনোভাব

যদিও ইউরোপের মতো জায়গায় পপুলিস্ট ডানপন্থীরা বেশ কয়েকটি দেশে এগিয়ে আছে তবে বিশ্বব্যাপী অসন্তুষের ক্ষেত্রে আদর্শিক সামঞ্জস্যতা তেমন একটা নেই।

সম্প্রতি ২৪টি গণতান্ত্রিক দেশে পিউ-এর জরিপে দেখা গিয়েছে, ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে তারা মনে করেন না যে রাজনীতিবিদরা তাদের মতো লোকেরা কী ভাবছেন তা নিয়ে তারা চিন্তা করেন এবং ৪২ শতাংশ বলেছেন যে কোনও রাজনৈতিক দল তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না।

“এটা অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বিষয়, তবে এটি রাজনীতির কার্যকারিতা সম্পর্কিতও,”বলেন পিউ'স গ্লোবাল এটিচিউডস রিসার্চের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিচার্ড উইক।

“এটা এমন এক পরিস্থিতির দিকে রাজনীতিকে নিয়ে যেতে পারে যখন দু’পক্ষই মনে করে অপরের ক্ষতি মানে নিজের লাভ। মানুষ প্রতিপক্ষর তরফ থেকে জীবন-মরণ হুমকি দেখতে পায়, যা মানুষকে গণতন্ত্র সম্পর্কে অসন্তুষ্ট করে তোল,” তিনি বলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে ক্ষোভের যে প্রবণতা, তার একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম আছে – যেসব দেশে নেতারা অ্যান্টি-এষ্টাবলিশম্যান্ট বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী, জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী।

লেভিটস্কি বলেন, “সিস্টেম বিরোধী, পপুলিস্ট ব্যক্তিত্বরা অতীতের চেয়ে বেশি জয়ী হচ্ছেন। তারা কোনো আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে কিনা তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

Mexican President-elect Claudia Sheinbaum holds a press conference, in Mexico City
লাতিন আমেরিকায় ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের ধারা ভেঙ্গেছেন মেক্সিকোর ক্লডিয়া শেইনবম। ফটোঃ ১১ জুন, ২০২৪।

লাতিন আমেরিকায় ধারা ভঙ্গ

মেক্সিকোতে রবিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থী প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরের নিজ হাতে বাছাই করা উত্তরসূরি হিসেবে ক্লদিয়া শেইনবম জয়ী হন। এর ফলে লাতিন আমেরিকায় ক্ষমতাসীন নেতাদের দলগুলোর পরাজয়ের ধারা ব্যাহত হল।

আর্জেন্টিনায় নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই, যিনি নিজেকে “অ্যানার্কো-ক্যাপিটালিস্ট” বলে দাবী করেন এবং ভক্তরা যাকে ম্যাডম্যান বা “পাগল” বলে অভিহিত করেছেন, তাঁর কৃচ্ছ্রসাধন এবং নিয়ন্ত্রণমুক্ত সংস্কারের পরে দেশটিতে ভেঙ্গে পরা অর্থনৈতিক সমস্যা চলতে থাকা সত্ত্বেও সেখানে তিনি জনপ্রিয়।

“আমি কখনোই রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলাম না কারণ কোনো কিছুই বদলায়নি,” ৩৭ বছর বয়সী প্রকৌশলী সেবাস্তিয়ান স্প্রোভিয়েরো বলেন। “এখন তা বদলাচ্ছে,” বুয়েন্স আয়রেসের একটি কনসার্ট দেখার সময় তিনি বলেন, যেখানে মিলেই রক সঙ্গিত চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। তবে পিউ জরিপে দেখা গেছে, যে সব দেশে জরীপ করা হয়েছে, তার মধ্যে ভারতে আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন সবচেয়ে বেশি। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা একটি শক্তিশালী নেতাকে সমর্থন করেছেন।

এসত্ত্বেও মোদীর মতো কর্তৃত্ববাদী সরকারকেও স্থিতাবস্থা নিয়ে অসন্তোষ মোকাবেলা করতে হয়েছে। মঙ্গলবার (৪ জুন) ঘোষিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে দৃশ্যত মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হয়েছেন।

তবে তার রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের ফলাফল ছিল হতাশাজনক এবং সরকার গঠনের জন্য তাঁর অন্য দলের সমর্থন প্রয়োজন।

APTOPIX India Prime Minister Modi
জরীপে দেখা যায়, ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কর্তৃত্ববাদী, শক্তিশালী নেতা চায়। ফটোঃ নয়াদিল্লি, ৯ জুন, ২০২৪।

'ফ্রিডম ইন্ডেক্স' নিম্নমুখি

বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাব এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধী পপুলিস্টদের সাফল্য গণতন্ত্রের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। পিউ জরিপে দেখেছে যে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিত সরকার ব্যবস্থা এখনও কাম্য হলেও এর আবেদন হ্রাস পেয়েছে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংগঠন ফ্রিডম হাউস যারা গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করে থাকে তারা বলছে, তাদের “ফ্রিডম ইনডেক্স” অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি টানা ১৮ বছর ধরে নিম্নগামী।

ফ্রিডম হাউসের ভাইস প্রেসিডেন্ট আদ্রিয়ান শাহবাজ এই সমর্থন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা, ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দা এবং করোনাভাইরাস মহামারীসহ শতাব্দীর শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক সংকটকে দায়ী করেছেন।

তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে, বিশেষত ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্সজেন্ডার নীতি এবং অভিবাসনের মতো ইস্যুতে ক্রমান্বয়ে মনোযোগ বাড়ার ফলে এই চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

“গণতান্ত্রিক সমাজে মূল ফাটলগুলো অর্থনৈতিক বিষয়ের চেয়েও আইডেন্টি বা জেন্ডার বা ব্যক্তি-পরিচয় ইস্যুকে ঘিরে রয়েছে,´ শাহবাজ বলেন। “কেবল এটাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে কারণ গণতন্ত্র একটি নাগরিক পরিচয়ের উপর নির্ভর করে যা ট্রাইবাল বা সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিচয়ের চাইতেও অনেক গভীর।

XS
SM
MD
LG