হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে বিরোধীদের উল্লাস প্রকাশের পর তাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেছে ইরানের ইসলামপন্থী শাসকরা।
আজারবাইজান সীমান্ত সফরের পর ইরানে ফেরার পথে খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হলে প্রেসিডেন্ট রাইসি ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিহত হন। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পাঁচ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন।
১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের গণহত্যার নির্দেশ দেবার সময় প্রসিকিউটর হিসেবে তার ভূমিকা বিতর্কিত থাকায় ইরানের কর্তৃত্ববাদী ইসলামপন্থী সরকারের বিরোধীরদের নিন্দার শিকার হন রাইসি। তাছাড়া ২০২২ সালের শেষের দিক থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকা দেশব্যাপী নারী অধিকার আন্দোলনকে সহিংসভাবে দমনে তার রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যবহার করার জন্যও ব্যাপকভাবে নিন্দিত হন তিনি।
এক্স প্ল্যাটফর্মে মঙ্গলবার রাজনৈতিক বন্দি ও অধিকার কর্মীদের পক্ষ নিয়ে কাজ করা ইরানভিত্তিক আইনজীবী গোষ্ঠী দাদবান জানিয়েছে, বেশ কয়েকজন নাগরিক যারা রাইসির মৃত্যুতে অনলাইনে আনন্দ প্রকাশ করেছেন তাদের কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার জন্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নির্দেশ পাবার কথা জেনেছেন তারা।
তার একদিন আগেই ইরানের সাইবার পুলিশ প্রধান, কর্তৃপক্ষ “সাইবারস্পেস সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে” এবং নাগরিকদের “উস্কানিমূলক” কোন কিছু লেখা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ইরানের ভিতরে এবং বাইরে রাইসির সমালোচকরা তাকে নিয়ে বিদ্রূপের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। অনেকে ফার্সি হ্যাশট্যাগ "হেলিকোটলেট" লিখে ব্যঙ্গ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে বাগদাদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শীর্ষ ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর তাকে "কাটলেট" হিসাবে উল্লেখ করে সমালোচকরা। হেলিকপ্টার এবং কাটলেট শব্দের সংমিশ্রণ "হেলিকোটলেট"।
ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ রাইসির মৃত্যুতে উদযাপন করতে মিষ্টি ও চকলেট বিতরন করে উদযাপন করছে বলে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া পোষ্টে ।
ভয়েস অফ আমেরিকা পার্সিয়ান টিভি উপস্থাপক মাসিহ আলিনেজাদকে পাঠানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইরানের অজ্ঞাত স্থানের একটি পাবলিক পার্কে মিষ্টি পেস্ট্রির ট্রে নিয়ে তার কাছে এসেছেন একজন নারী।
ইরানের ইস্পাহানের একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনও মিষ্টি বিতরণের পোষ্ট টেলিগ্রামে পোস্ট করেছেন।
ইরানের অভ্যন্তরে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ভিওএ স্বাধীনভাবে ভিডিওগুলোর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তেহরানের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত এক কিশোরের মা প্রকাশ্যে রাইসির প্রতি তার বিরোধিতা প্রকাশ করেন। এক ইন্সটা পোস্টে আমির আতাইয়ির মা মরিয়ম বলেন, রাইসুর মৃত্যু তার মতো আরও মায়েদের আর্তনাদের জবাব।
দাদবান বলেন, ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কারাজের কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে রাইসির মৃত্যুতে আনন্দিত রাজনৈতিক বন্দিদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এবং তাদের অজ্ঞাত স্থানে স্থানান্তর করেছে।
ইরানভিত্তিক সাংবাদিক মানিঝেহ মোয়াজেন বলেন, কর্তৃপক্ষ তাকে টার্গেট করেছে।
ইরানি-আমেরিকান মানবাধিকার আইনজীবী ও আটলান্টিক কাউন্সিলের বিশ্লেষক গিসো নিয়া ভয়েস অব আমেরিকার আফগান সার্ভিসকে বলেছেন, এই উদযাপনের কারণ রাইসির প্রতি ঘৃনা। জনগণের কাছে তার অজনপ্রিয়তা। তার নীতির ফলে নারীর ওপর চরম সহিংসতা সৃষ্টি হয়। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নৃশংস অপরাধে অপরাধী ছিলেন।
পশ্চিমের প্রধান শহরগুলোতে প্রবাসী বিরোধী ইরানিরাও তাদের আনন্দ প্রকাশ্যে উদযাপন করছে। সোমবার লন্ডন, কোপেনহেগেন, দি হেগ ও হামবুর্গে ইরানি কূটনৈতিক মিশনের বাইরে ইরানিরা ইরানের প্রাক-ইসলামি পতাকা উড়িয়ে গানের তালে নেচে ওঠে। সোমবার টরন্টোর মিডটাউনে এবং মঙ্গলবার স্টকহোম ও ফ্রাঙ্কফুর্টেও একই দৃশ্য দেখা যায়।
টরন্টো থেকে ভয়েস অফ আমেরিকার পার্সিয়ান সার্ভিসের সাংবাদিক নিউশা বোঘরাতি, বেহরুজ সামাদবেগি এবং বেহরাং রাহবারির সহযোগিতায় এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ভয়েস অব আমেরিকার আফগান সার্ভিসের জিলা নুরি এতে অবদান রেখেছেন।