অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

খরচ কমাতে হলে ভর্তূকী কমাতে হবে: ড. জাহিদ হোসেন


জাহিদ হোসেন
জাহিদ হোসেন

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ‘কেমন বাজেট চাই’; এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের মতামত জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ; যিনি বিশ^ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মূখ্য অর্থনীবিদ ছিলেন, ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে তার মতামত জানিয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রেদওয়ানুল হক।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আগামী বাজেটে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত? কেন?

ড. জাহিদ: সামষ্টিক অর্থনৈতিক দিক থেকে বাজেটের কৌশলগত অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে চারটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরী।

এক. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটের করণীয় ঠিক করা।
দুই. বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজে বেড় করা।
তিন. আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে বাজেটের ভূমিকা নির্ধারণ করা এবং
চার. পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে বাজেট কিভাবে সহায়ক হতে পারে সেটি নিশ্চিত করা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাজেট বাস্তবয়ন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী কী করা দরকার?

ড. জাহিদ: বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খরচের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজেট তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ যেটি না হলেই নয় কিংবা না হলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এরপর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতে সময়মতো অর্থ ছাড় নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সময়মতো রিপোর্টিং করা এবং রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আয় বাড়ানোর জন্য কী করা দরকার?

ড. জাহিদ : দুটি পদক্ষেপ এর মাধ্যমে আয় বাড়ানো যেতে পারে -

এক. কর নীতিতে যেসব খাতে ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে ছাড় দিয়ে সুফল মিলছে না তাতে সংস্কার আনতে হবে।
দুই. একই খাতে বিভিন্ন ধরনের রেট আছে এগুলো কমিয়ে এনে একক রেটের দিকে যেতে হবে। কারণ ২০১২ সালে যে আইন ছিল সেখানে ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সব খাতে ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়।

এছাড়া কর উত্তোলনের লিকেজগুলো কমানো দরকার। অর্থাৎ কর দাতা টাকা দিচ্ছে কিন্তু কোষাগারে জমা হচ্ছে না এমন সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন কোন খাতে খরচ কমানো উচিত?

ড. জাহিদ : খরচ কমাতে হলে ভর্তূকী কমাতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু মূল্যবৃদ্ধি একমাত্র পন্থা নয়। এর বাইরে আরেকটি কৌশল আছে সেটি হল উৎপাদন খরচ কমানো। এছাড়া রেমিটেন্সসহ কিছু খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে যার কোন ফলাফল আসছে না, সেগুলো বন্ধ করতে হবে।

এছাড়া এডিপি বহির্ভূত মূলধন ব্যয় কমাতে হবে। বিশেষ করে ভবন এবং বাহন খাতে ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে এডিপির মধ্যে মেগা প্রজেক্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে এর ভূমিকা নির্ণয় করা জরুরি। পরিবহন এবং পল্লী উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান খাতের আওতায় নন-মেগা প্রজেক্টেও প্রচুর অপচয় হচ্ছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আইএমএফ বাজেটের আকার ছোট রাখতে বলেছে, আপনি কী একমত? কেন?

ড. জাহিদ: বাজেট ঘাটতি যাতে না বাড়ে সেই সুপারিশ করেছে আইএমএফ। তবে এটি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য। আর এখন যেটি করতে বলেছে সেটি হলÑ তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে কৌশল নির্ধারণ করে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা। এ বিষয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। বর্তমানে ঘাটতি বাড়ানোর অর্থ হচ্ছে চড়া মূল্যস্ফীতিতে ঘি ঢালার শামিল।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন তিনটি খাতে সংষ্কার সবচেয়ে জরুরি কেন? কী করা উচিত?

ড. জাহিদ : মূলত নীতিগত সংস্কার করতে হবে। বেশি গুরুত্ব দিয়ে যে তিনটি খাত দেখতে হবে তা হল --

এক. আর্থিক খাতে অনেক দুর্বল প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এদের অনেকেই দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান। অবসায়ণের মাধ্যমে হোক অথবা কেউ যদি কিনতে চায় কিংবা মার্জার হোক এগুলোর সমাধান করতে হবে। তবে বর্তমানে যে মার্জার প্রক্রিয়া চলছে তাতে কোনোটিই হচ্ছে না।

দুই. ব্যবসায়িক নীতিমালাগুলো সংস্কার করতে হবে। নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুমোদন প্রক্রিয়ার কারণে দীর্ঘসূত্রতা এবং জটিলতা আছে; এগুলো সরলীকরণ করতে হবে। অন্যদিকে নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে।

তিন. সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যেসব সহায়তা কর্মসূচি রয়েছে এগুলোতে দুই ধরনের সংস্কার দরকার। প্রথমত খাদ্য ভিত্তিক কর্মসূচি কমিয়ে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে সরাসরি নগদ সহায়তা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, টার্গেটিং ঠিক করা অর্থাৎ, এমন যাতে না হয় যে যারা পাচ্ছেন তাদের দরকার নেই আর যাদের দরকার তারা পাচ্ছেন না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাজেট তৈরির সময় কোন কোন চ্যালেঞ্জের কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাথায় রাখা দরকার?

ড. জাহিদ : বাজেট তৈরিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক্ষেত্রে ক্রেডিবিলিটি বা বিশ্বাসযোগ্যতা জরুরী। এমন কিছু ঘোষণা করা বা ওয়াদা করা উচিত নয় যেটি রাখতে পারব না। তাছাড়া টার্গেট গুলো যাতে বাস্তবসম্মত হয়, এতে সংশ্লিষ্টরা লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ হবে। একই সঙ্গে জবাবদিহিতার কার্যকর লক্ষ্য ঠিক করা।

মূলধনী ব্যয় এবং পরিচালন ব্যয়ের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হবে। এমন যাতে না হয় যে স্কুল বানালাম কিন্তু শিক্ষক নেই। গাড়ি দিলাম কিন্তু তেল দিলাম না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: গত পাঁচ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে কোন দুর্বলতা সীমাবদ্ধতা বা ভুলগুলো চোখে পড়েছে? এগুলো এড্রেস করা হয়েছে কি? কী করা উচিত?

ড. জাহিদ : চোখে পড়ার মতো ত্রুটি হলো, আসল বাজেট, সংশোধিত বাজেট এবং বাস্তবায়িত বাজেটের মধ্যে বড় ফারাক। এটি প্রতিবছরই হচ্ছে। আবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজেট খরচ করতে পারেনা যেটি বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে। এই অব্যবস্থাপনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। দুই. এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধির সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে এটি চোখে পড়ার মত।

ভয়েস অফ আমেরিকা: অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লিঙ্গসমতা অর্জনের জন্য বাজেটে কী সংযোজন বা বর্জন করা যেতে পারে?

ড. জাহিদ: শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে নারীদের টার্গেটিংটা ভালভাবে হওয়া দরকার। বর্তমানে স্বাস্থ্য ও শিল্প খাতের কিছু প্রকল্প খুব ভালো করছে। সেগুলোর আওতা বাড়ানো যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কৃষি ও শিল্প খাতে যেসব ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা আছেন তাদের মূলধন যোগান এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত, শহরে নারীদের কাজের সুবিধার্থে শিশু ডে-কেয়ার দরকার। ২০২১ সালে এ সংক্রান্ত একটি আইন হয়েছে সেটির প্রয়োগ দরকার।

ভয়েস অফ আমেরিকা: গত পাঁচবছরে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতার বিচারে সরকারকে ১০ এ কত দেবেন?

ড. জাহিদ: প্রথমে ভেবেছিলাম ১০ এর মধ্যে ৫ দেই। এর অর্থ হচ্ছে সফলতা ও ব্যর্থতা সমান। কিন্তু বাস্তবতা হলো ব্যর্থতাই বেশি। তাই ৪ দিচ্ছি।

XS
SM
MD
LG