আমেরিকায় শামারুখ মহিউদ্দিন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন। আমেরিকায় তিনি তার সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচিতির সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।
ওয়াশিংটন এলাকার বিজনেস কনসাল্টেন্ট মহিউদ্দিন এশিয়ান আমেরিকানদের নানা বিষয়ে সহযোগিতা করেন, রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক ফিয়েস্তা এশিয়া অনুষ্ঠানের একটি নৃত্য দলের সাথে নৃত্য পরিবেশনা এবং ফর্মগুলিতে “এশিয়ান” লেখা জায়গাটি পরীক্ষা করা। তবুও যেন পুরোপুরি পরিচয়টা ব্যাখ্যা করা যায় না।
তিনি নিজেকে "বাংলাদেশি আমেরিকান" পরিচয়টি দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন, এতে যে গভীরতা আছে সেটা তাকে এবং তার বাংলাদেশী বন্ধুদের একই সূত্রে অনুরণিত করে।
মহিউদ্দিন বলেন, “ আমার বেশিরভাগ বন্ধু যখন তারা তাদের পরিচিতির সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যকে যুক্ত করে তখন তারা সাধারণত তাদের নিজের দেশের নামটি ব্যবহার করে। যেমন ইন্ডিয়ান-আমেরিকান বা বাংলাদেশি-আমেরিকান বা ফিলিপিনো-আমেরিকান।
যুক্তরাষ্ট্রে মে মাসটিকে “এশিয়ান আমেরিকান, নেটিভ হাওয়াইয়ান এবং প্যাসেফিক আইল্যান্ডার মান্থ” হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, যা কিনা আমেরিকার ক্রমবর্ধমান জাতিগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্য উদযাপনের জন্য যে মাসগুলো নির্ধারিত আছে,তারই একটি।
একসময় পূর্ব এশীয় বংশদ্ভুত আমেরিকানদের প্রাথমিকভাবে বোঝানোর জন্য "এশিয়ান আমেরিকান" বলে বর্ণনা করা হতো, তা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সকলের মধ্যেই একটা প্রচলিত শব্দগুচ্ছ হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, সরকারী সংস্থা এবং অন্যান্যরা নানা দেশের এশিয়ানদের এভাবে বর্ণনা করে থাকেন। তবে সব এশিয়ান আমেরিকান সমান উৎসাহের সাথে এটাকে গ্রহণ করেন না।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং এশিয়ান আমেরিকান পরিচয় বিকাশ সম্পর্কিত একটি বইয়ের লেখক দিনা ওকামোটো বলেন, “কিছু মানুষ এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন কারণ এটি ব্যাপক ও বিস্তৃত এবং পার্থক্য যে আছে তার স্বীকৃতি দেয় না বা তা স্বীকার করে না তবে আমি এখনও মনে করি কিছু লোকের জন্য এটি একটি খুব অর্থবহ শ্রেণীবিন্যাস এবং পরিচয়ও।
“এশিয়ান আমেরিকান” সক্রিয়বাদীদের তৈরি
১৯৬৮ সালে “এশিয়ান আমেরিকান” শব্দগুচ্ছটি উদ্ভূত হয়। বার্কলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার, সক্রিয়কর্মী(দুই শিক্ষার্থী) ইউজি ইচিওকা এবং এমা জি এই শব্দগুচ্ছ তৈরি করেছিলেন। আগে এশিয়ান আমেরিকানদের তারা কোন দেশ থেকে এসেছেন সেই দেশ দ্বারা তাদের চিহ্নিত করা হতো ঐ সময় “ওরিয়েন্টাল” শব্দব্যবহার অবজ্ঞামূলক ভাবা হত না।
১৯৬০-এর দশকে ইচিওকা এবং জি বর্ণবাদ বিরোধী এবং যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তখনই তারা আমেরিকার বিভিন্ন অসম এশীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রাজনৈতিক সংহতি প্রচারের জন্য প্যান-এথনিক বা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয় তৈরি করেছিলেন যেখানে বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের অনুরূপ অভিজ্ঞতা ছিল।
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বিষয়ক ইতিহাসবিদ এবং ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকের এশিয়ান আমেরিকান আন্দোলন নিয়ে একটি বইয়ের লেখক ড্যারিল জোজি মায়েদা বলেন, “এটি যুক্তরাষ্ট্রে এশীয় বংশোদ্ভূত সমস্ত মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি প্রধান শব্দপুঞ্জ হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল, তবে এই শব্দপুঞ্জটি একাধিক জাতিগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে বোঝানোর চেয়ে বরং তা একটি রাজনৈতিক অবস্থানের দিকে ইংগিত দেয়।
কয়েক দশক ধরে, এই শব্দটির (এশিয়ান আমেরিকান) মূলত যে রাজনৈতিক ধারণাদ্বারা আবদ্ধ ছিল তা ত্যাগ করে এবং এশীয় বংশোদ্ভূতদের সনাক্তকরণের জন্য একটি অভিন্ন পরিচয় হিসেবে বিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন সরকারের এই শব্দপুঞ্জ গ্রহণেরই অংশ।১৯৯০ সালের আদমশুমারির প্রশ্নাবলীতে “এশিয়ান অর প্যাসিফিক আইল্যান্ডার” অর্থাত্ এশীয় বা প্রশান্তমহাসগরীয় দ্বীপবাসী বিভাগটি যুক্ত করা হয়।
.মায়েদা ভয়েস অব আমেরিকাকে ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়েছেন যে “'আজকে এশিয়ান আমেরিকান এই অর্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।
তবে বৃহত্তর অর্থ এই শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে এই কারণে যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি হবার ফলে আমেরিকার এশীয় সম্প্রদায়ে (নানা দেশ) আরও বৈচিত্র এসেছে। আমেরিকার এশীয় সম্প্রদায় একসময় ছিল প্রধানত চীনা, জাপানি এবং ফিলিপিনোদের নিয়ে। তবে আজ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কয়েক ডজন জাতি বা দেশকে এবং এই জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ।
মায়েদা বলেন, “তাই এশিয়ান এবং এশিয়ান আমেরিকান বলতে কেবলমাত্র পূর্ব এশিয়ার মানুষদের কে বোঝায় এমনটা ভাবা অযৌক্তিক বা বোকামি হবে।
সাধারণ আলোচনায়, শব্দটি আকর্ষণ অর্জন করছে। অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী সংস্থাগুলি কেবল পূর্ব এশীয়দের নয়, এশিয়ান ঐতিহ্যের সমস্ত লোককে বর্ণনা করার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে এই শব্দপুঞ্জ ব্যবহার করছে। স্কুল ডিস্ট্রিক্ট এ দক্ষিণ এশীয় শিক্ষার্থী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায়ই এশীয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়।তবে, "এশিয়ান আমেরিকান" কমিউনিট সদস্যরা নিজেদের যেভাবে দেখেন তা তাদের প্রতিফলিত করে না।
পিউ গবেষণায় আত্মপরিচিতি
এশিয়ান আমেরিকানরা কীভাবে নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরেমতা জানতে পিউ রিসার্চ গত বছর একটি সর্ববৃহৎ জরিপ চালিয়েছিল: জরিপটিতে দেখা গিয়েছে, নিজেদেরকে কেবল ১২ শতাংশ “এশিয়ান এবং ১৬ শতাংশ “এশিয়ান আমেরিকান” বলে বেছে নিয়েছে, আর অর্ধেকের বেশী অথবা ৫২ শতাংশ নিজেদের “আমেরিকান” সহ বা ছাড়া কেবল তারা যে নির্দিষ্টি জাতিগোষ্ঠীর --- চাইনিজ বা ভারতীয় সেই পরিচয়ই পছন্দ করে।
পিউ গবেষণার মতে, পরিচিতি হিসাবে "এশিয়ান"-এর ব্যবহার অবশ্য জাতিগোষ্ঠী অনুযায়ী বিভিন্ন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ভুটানি এবং বাংলাদেশীর মতো ছোট গ্রুপের ২৩% লোক নিজেদের “এশিয়ান” বলতে পছন্দ করেছিলেন, যা পিউ জরিপ অনুযায়ী সর্বমোট হারের দ্বিগুণ। তবে, বড় গোষ্ঠীগুলির ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের জাতীয়াতা ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন যেমন, চাইনিজ এবং ইন্ডিয়ান আমেরিকানস।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জাতি ও জাতিগোষ্ঠীগত গবেষণার সহযোগী পরিচালক সাহানা মুখার্জি বলেন, “ এশিয়ান” শব্দটি প্রায়ই কম পরিচিত গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা ব্যবহার করেন কারণ এই (শব্দটি) ব্যাপকভাবে স্বীকৃত।
ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুখার্জি বলেন, “তাদের জন্য এথনিক লেবেল বা জাতিগোষ্ঠীগতভাবে চিহ্নিত হওয়ার চাইতে এশিয়ান শব্দটি ব্যবহার করা অনেক সহজ।
তা সত্ত্বেও এখনও “এশিয়ান” শব্দটি পূর্ব এশিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। পিউ জরিপে বলছে, এশিয়ান আমেরিকানদের মধ্যে ৮৯% একে পূর্ব এশীয়দের সাথে ৬৭% দক্ষিণ এশীয়দের সাথে এবং মাত্র ৪৩% মধ্য এশীয়দের সাথে নিজেদের দেখেছেন।
কেউ কেউ ভারতীয়দের সাথে নেটিভ আমেরিকানদের গুলিয়ে ফেলেন
ভারতীয় অভিবাসী পরিবারের সন্তান নিখিল বাম্বের জন্ম আমেরিকায়। তিনি বলেন, ১৯৯০ ও ২০০০ দশকে যখন তিনি সাউথ ক্যারোলাইনায় বড় হচ্ছিলেন তখন “এশিয়ান” শব্দটি প্রধানত পূর্ব এশীয়দের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হতো।
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এফএসজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাম্ব বলেন, “বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাকে বলা হতো যে আমি এশিয়ান নই।সে কারণে আমার ধরণা যে এশিয়ান বলতে বেশিরভাগ লোকেরা যা বোঝাতে চেয়েছিলন তা ছিল পূর্ব এশীয়। সাধারণভাবে কথাটা এ রকমভাবে ব্যবহার হতো।
তিনি নিজেকে ভারতীয় আমেরিকান হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, তবে এতেও কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল। কেউ কেউ এই শব্দটিকে আদিবাসী আমেরিকানদের সাথে গুলিয়ে ফেলতেন।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাম্ব বলেন, “আমার মনে হয়, এখন আরও ভালভাবে বোঝা যায় যে ইন্ডিয়ান আমেরিকান বলতে ভারত থেকে আসা লোকদের বোঝায় ... কিন্তু যখন বড় হচ্ছিলাম তখন অবশ্যই অনেক বিভ্রান্তি হয়েছে। যখনই আপনি বলবেন, “আমি ইন্ডিয়ান” বা “আমার বাবা-মা ইন্ডিয়ান” লোকেরা বলবে, “ তোমাকে কিন্তু ইন্ডিয়ান বলে মনে হচ্ছে না।”
তোমাকে দেখতে এশিয়ান লাগছে না
টেক্সাসে বসবাসকারী পাকিস্তানি আমেরিকান সক্রিয়বাদী এবং লাইফস্টাইল কোচ আয়েশা আলম খানের কাছে পাকিস্তানি মানেই হচ্ছে সাউথ এশিয়ান বা দক্ষিণ এশীয় না হলেও, এশিয়ান।
যখন সে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়ে ছিলেন তখন এটি কিছুটা কালচার শকে মত ছিল। তিনি নিজেকে যখন “এশিয়ান” হিসাবে পরিচয় দিতেন তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়তো ।
পাকিস্তানের সাবেক মডেল এবং রেডিও ও টিভি উপস্থাপক খান বলেন, “মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে বলত, “ওহ!আপনাকে দেখেতো এশিয়ান মনে হয়না।
খান পাকিস্তানি এবং ইউরোপীয় বংশদ্ভুত সে কারণে তাঁর গায়ের রঙে ফর্সা। কিন্তু গায়ের রং নয়, “পূর্ব এশীয়” স্টেরিওটাইপ। সে কারণেই বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে বলে জানান তিনি।
খান বলেন, “আমি বুঝতে পারতাম যে তারা আসলে কি বোঝাতে চাইতো। তাদের ধারণা অনুসারে তারা আমাকে চীনা বা জাপানি বা কোরিয়ানদের মতো দেতে চাইত। যে দেশগুলোকে আমরা দূর প্রাচ্য হিসাবে বিবেচনা করি” ।
তিনি বলেন, যতক্ষণ না মানুষ এশীয় বৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও বেশী পরিশীলিত ধারণা অর্জন করছে ততক্ষণ এই শব্দটি “এই মুহুর্তে কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়”।
তিনি বলেন, তাঁর বন্ধুরা যেমনটি করে, আপাতত অবশ্য তিনি নিজেকে পাকিস্তানি বা সাউথ এশিয়ান আমেরিকান পরিচিতিটা বহাল রাখছেন।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওকামোটো বলেন, তিনি এশিয়ান ডাইভার্সিটি বা এশিয়ার বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমেরিকানদের ধরণার উন্নতি লক্ষ্য করেছেন। তিনি বলেন, কর্মজীবনের শুরুর দিকে তাকে জিজ্ঞাসা করা হতো দক্ষিণ এশিয়ানদের এশিয়ান ক্যাটাগরিতে রাখা বিষয়ে, এখন তা আর করা হয়না।
তিনি বলেন, “আমি জানি না তারা এখনও অবাক হন কি কিনা”।
মহিউদ্দিন ২০০০ সালের গোড়ার দিকে মেইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনিও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। এশিয়ান আমেরিকান গ্রুপগুলোতো যদিও এখনও বেশিরভাগই ইষ্ট এশিয়ান আমেরিকানরা নেতৃত্ব দিচ্ছে তবে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ এশীয়রা সেখানে সামিল হয়ে নিজেদের সংশ্লিষ্ট পদে যুক্ত হচ্ছে এবং ব্যাপক সংখ্যক এশীয় প্রবাসীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
মহিউদ্দিন স্মরণ করলেন, সম্প্রতি এশিয়ান আমেরিকানস অ্যাডভান্সিং জাস্টিস আয়োজিত একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে তিনি বেশ কয়েকজন দক্ষিণ এশীয়কে দেখেছেন।
তিনি বলেন, “সুতরাং আমি মনে করি যে ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন ঘটছে।