অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এখন বহিষ্কারের আশঙ্কায়


করাচির এক আফগান-অধ্যুষিত এলাকায় নীল বোরকা পরা আফগান নারী বাজার করছেন। ফটোঃ ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪।
করাচির এক আফগান-অধ্যুষিত এলাকায় নীল বোরকা পরা আফগান নারী বাজার করছেন। ফটোঃ ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪।

পাকিস্তানে জন্ম ১৮ বছর বয়সী এক আফগান তরুণ যার মা-বাবা অর্ধশতাব্দী আগে আফগানিস্তান থেকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছিলেন। এই তরুণের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানেই। করাচির পুলিশ তার কাছ থেকে নগদ টাকা, ফোন এবং মোটরবাইক কেড়ে নেয় এবং তাকে প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়।

ভীত ও হতবিহ্বল তরুণটিকে সেখানে তিনদিন ধরে রাখার পর তাকে একবস্ত্রে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়--- যেখানে সে আগে কখনো যায়নি।

আফগানিস্তানের কয়েক দশকের যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানকে নিজেদের বাসা বানিয়েছেন, এমন অন্তত ১৭ লক্ষ আফগান রয়েছেন। যাদের একজন এই তরুণ।

তবে পাকিস্তান বলছে বেআইনিভাবে পাকিস্থানে বসবাসকারীদের দেশত্যাগ করতেই হবে। পাকিস্তানে ঐসব অভিবাসীদের লক্ষ্যকরে কঠোর দমনপীড়ন শুরু হয়েছে।

পাকিস্তানে আত্মগোপন

গত অক্টোবর মাস থেকে ধর-পাকর শুরু হবার পর থেকে প্রায় ৬ লক্ষ আফগান তাদের দেশে ফিরে গিয়েছে অর্থাৎ আরও অন্তত ১০ লক্ষ আফগান পাকিস্তানে আত্মগোপন করে আছে।

জোরকরে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠাবে সেই ভয়ে তারা সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকছেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এবং তাদের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরুচ্ছেন না।

তাদের পুলিশের হাতে ধরা পরার ভয় বা পাকিস্তানি লোকজন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারে এমন ঝুঁকির কারণে ঐসব মানুষের পক্ষে অর্থ উপার্জন, ভাড়া করার জন্য বাড়ি পাওয়া, খাবার কেনা অথবা চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে পরেছে।

একজন যুবক যে ১৫ বছর বয়স থেকে একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে মেকানিকের কাজ করছে, গ্রেপ্তার ও বহিষ্কারের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলে।

নাম-পরিচয় গোপন রেখে এই ১৮-বছর বয়স্ক আফগান তরুন কথা বলেন এপি'র সাথে। ফটোঃ ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪।
নাম-পরিচয় গোপন রেখে এই ১৮-বছর বয়স্ক আফগান তরুন কথা বলেন এপি'র সাথে। ফটোঃ ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪।

সে তার পরিবারের কাছে যে ডকুম্যান্ট বা কাগজপত্র আছে সেই একই ডকুম্যান্ট পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল কিন্তু সে তা পাবে না। পাকিস্তান সরকার আফগান শরণার্থীদের বা তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কোনরকম আইনসংগত কাগজপত্র ইস্যু করছে না।

“সারাটা জীবন আমার এখানেই। আফগানিস্তানে আমার কেউ নেই, বন্ধু বা পরিবার কিছুই নেই,” অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে যুবকটি জানিয়েছে। দেশজুড়ে অভিবাসী বিরোধী অভিযান চলার কথা উল্লেখকরে সে বলল, “আমি পাকিস্তানে আরও আগে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু প্রথমেতো পরিস্থিতি শান্ত হওয়া দরকার।”

আফগানিস্তানে নতুন জীবন

আফগানিস্তানে পৌঁছানোর পর তালিবান কর্তৃপক্ষ তাকে নতুনভাবে জীবন শুরু করার জন্য ২৫০০ আফগানি টাকা (৩৪ ডলার) দেয়েছিল এবং তাকে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় তাখার প্রদেশের পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখানে চেনা-জানা কেউ না থাকায় সে মসজিদ এবং মাদ্রাসায় ঘুমাতো।

ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলে সময় কাটাতো। অন্যের কাছ থেকে ফোন ধার করে বাবা-মা, পরিবারের কাছে ফোন করতো।

ছয় সপ্তাহ পরে তাখার থেকে সে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে আসে এবং সেখান থেকে নানগারহার প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে যায়। রাতের অন্ধকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে হাঁটতে হয়েছিল। অবশেষ মানব পাচারকারীদের সঙ্গে তার দেখা মেলে।

পাকিস্তানে তার ভাই মানব পাচারকারীদের ভাড়া করেছিলেন। তাদের দায়িত্ব ছিল সত্তুর ডলারের বিনিময়ে তাকে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল খাইবার পাখতুনখোওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারে নিয়ে যাওয়া।

পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে সে স্বস্তি পেয়েছে ঠিক কিন্তু সে নিরুপায় বোধ করছে। পুলিশ তার পাড়ায় আশেপাশের বাড়িগুলোতে নম্বর লিখে দিয়ে গেছে, বাড়িগুলোতে কতজন করে বসবাস করে, তাদের কতজনের কাগজপত্র আছে তা দেখানোর জন্য।

ঐ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে শত শত আফগান পরিবার ঐ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। লোকরে সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা যাচ্ছে না।

করাচির এক এলাকায় দু'জন আফগান নারী বাচ্চা নিয়ে হাঁটছেন। ফটোঃ ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪।
করাচির এক এলাকায় দু'জন আফগান নারী বাচ্চা নিয়ে হাঁটছেন। ফটোঃ ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪।

তাড়িয়ে দেয়ার গুজব

করাচীতে এমন এলাকা আছে যেখানে হাজার হাজার আফগান বাস করছে কিন্তু সেখান কোন নালা নেই, স্বাস্থ পরিসেবা বা শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।

রাস্তাগুলোতে খুব কম নারীদের দেখা যায় তবে যারা বাইরে যান তারা বোরকা পড়ে বের হন। প্রায় আফগানিস্তানের মত নীল রং-এর বোরকা দেখা যায়।

আইনজীবী মনিজা কাকার করাচীতে আফগান সম্প্রদায়ের সাথে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। তিনি বলেন, এখানে এমন পরিবার আছে যাদের কয়েক প্রজন্ম ধরে কোনও কাগজপত্র নেই। কাগজ না থাকায় তারা স্কুলে যেতে বা হাসপাতালের মতো প্রাথমিক পরিসেবাগুলিও পায় না।

ধরপাকড় শুরুর আগে থেকেই আফগানদের দিকে নজর রাখা হচ্ছিল এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পাকিস্তান চায় সব আফগানকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে, এমনকী যাদের আইনী কাগজপত্র আছে তাদেরকেও।

তবে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে পাকিস্তান।

করাচীতে আরেকটি এলাকা যেখানে বেশীর ভাগ আফগান লোকজন বাস করেন সেখানে পুলিশ যাওয়ার পরে লোকজন সরু অলিগলিতে লুকিয়ে পরে।

তথ্যদানকারী একটি নেটওয়ার্কে মাধ্যমে পুলিশ আসার খবরটি ছড়িয়ে পরে।

করাচির এক পাড়ায় অবৈধ অভিবাসী খুঁজতে পুলিশ স্থানীয় বাসিন্দাদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করছেন। ফটোঃ ৩ নভেম্বর, ২০২৩।
করাচির এক পাড়ায় অবৈধ অভিবাসী খুঁজতে পুলিশ স্থানীয় বাসিন্দাদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করছেন। ফটোঃ ৩ নভেম্বর, ২০২৩।

কাকার পাকিস্তানে থাকা আফগানদের দুর্দশা দেখে হতাশ। তিনি বলেন, “অনেক সময় তাদের কোন খাবার থাকে না। আমরা জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছি তাদেরকে সাহায্য করার জন্য।”

তিনি বলেন, আগে এরা ঐসব এলাকা থেকে বেরিয়ে করাচীর শহরতলিতে অর্থ উপার্জন বা চিকিৎসার জন্য যেতেন। কিন্তু তারা এখন ভয় পায় যে বাইরে বেরুলে তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারে।

জিয়া উল হকের আমল

কেউ কেউ কাকারকে তাদের আইডি কার্ড দেখিয়েছেন যা তারা পেয়েছিলেন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া উল হকের শাসনামলে যখন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ঘটেছিল।

“চল্লিশ বছর পরেও কেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না সেটা তাদের কাছে বিস্ময়। তারা কোথায় থাকেন তা তারা জানান না। তারা বাইরে যান না। তারা অন্যের নামে বাড়ি ভাড়া করেন।”

পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং বড় হয়েছেন এবং এখন এদেরও সন্তানসন্ততি হয়েছে । “এই শিশুদের কোনো পরিচয়পত্র নেই। এদের সবারই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত,” কাকার বলেন।

করাচীর আফগানিস্তান কনস্যুলেট জেনারেলে সৈয়দ হাবিব উর রেহমান মিডিয়া সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করেন। এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে তিনি অনেক সময় কাটান।

“বাড়িগুলো ফাঁকা, দোকানপাটও ফাঁকা,” রেহমান বলেন। “বাজারগুলো ফাঁকা। আমরা যেসব পাকিস্তানিদের চিনি তারা এটা মানতে পারছেন না। তারা বলেন, তারা আমাদের সঙ্গে সুন্দর জীবন কাটিয়েছেন। অনেক আফগান পরিবার চলে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা বাণিজ্য কমে গেছে।”

পাকিস্তানের তোরখাম সীমান্তে ট্রাকে করে আফগান পরিবারদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ফটোঃ ৩১ অক্টোবর, ২০২৪।
পাকিস্তানের তোরখাম সীমান্তে ট্রাকে করে আফগান পরিবারদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ফটোঃ ৩১ অক্টোবর, ২০২৪।

'করাচি আমার শহর'

এপি যেসব আফগানদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তারা নানা কারণে পাকিস্তানে থাকার জন্য আইনি কাগজপত্র কখন জোগাড় করে নি। কেউ কেউ বিদেশে কর্মরত ছিলেন। অন্যরা অন্যদের সময় ছিল না। কেউ ভাবেনি যে পাকিস্তান তাদের কখনো বের করে দিবে।

করাচীতে জন্মগ্রহণকারী ৩২ বছর বয়সী মোহাম্মদ খান মুঘলের তিন সন্তান। ধর-পাকর শুরু হওয়ার আগে তিনি তন্দুরের ব্যবসা চালাত। পুলিশ তাকে ঐ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বলে।

তিনি বলেন, “আমার কাষ্টমাররা অভিযোগ করতে শুরু করেছিলেন কারণ তারা আমার কাছ থেকে রুটি কিনতে পারেছিলেন না।”

পুলিশের অভিযানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি ও তার পরিবার বেলুচিস্তান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কোয়েটায় চলে গিয়েছিলেন।

তবে কয়েকদিনের মাঝেই তিনি করাচীতে ফিরে আসেন এবং চলে যাবার কোনো ইচ্ছা তার আর নেই।

“এটাই আমার বাড়ি,” গর্ব ও দুঃখ মিশ্রত ভাবেই তিনি বলেন। “এটাই আমার শহর।”

XS
SM
MD
LG