ইরান কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্য যে প্রক্সি বা ছায়া-যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল, তার অবসান ঘটলো সপ্তাহান্তে ইসরাইলের উপরে সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধির মধ্যেই দেশের ধর্মতান্ত্রিক নেতৃত্ব নতুন পথ বেছে নিয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি শুক্রবার ৮৫ বছর বয়স পূর্ণ হতে যাচ্ছে, কিন্তু ইরানে তার স্থালাভিষিক্ত হবার মত কোনও উত্তরসূরি দেখা যাচ্ছে না। তিনি এখনও ইরানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসাবে কাজ করছেন।
ইরাকের সঙ্গে ১৯৮০’র দশকে ইরানের আট বছরের মারাত্মক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে খামেনি ক্ষমতায় আসেন এবং তার সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলায় সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে “কৌশলগত ধৈর্যের” কথা বছরের পর বছর প্রচার করেছেন।
এর ফলে, ইসরাইলকে হয়রানি করার জন্য ইরান আঞ্চলিক মিলিশিয়া বাহিনীগুলোতে আরও গভীরভাবে বিনিয়োগ করেছে - যেমন গাজা উপত্যকার হামাস বা লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া বাহিনীর উপর।
এমনকি দরিদ্রপিড়িত দেশ ইয়েমেনেও এই প্রভাব ইরান সম্প্রসারিত করেছে। যেমন, ইরানের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্রের জন্যই হুথি বিদ্রোহীরা তাদের রাজধানী দখল করার মত ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং সেখানে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে আটকে দিতে পেরেছে।
'জায়নিস্ট সরকারকে শাস্তি'
এই কৌশল শনিবার বদলে যায়। বেশ কয়েক দিন ধরে হুঁশিয়ারি দেয়ার পর ইরান – ইসরাইলের হিসেব অনুযায়ী - ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ১৭০টি বোমা বহনকারী ড্রোন, ৩০টিরও বেশি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১২০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
ঐসব অস্ত্রের মধ্যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সরবরাহ করা বোমা বহনকারী ড্রোনও রয়েছে।
যদিও ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র এসব ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ ভাগ ভূপাতিত করার দাবী করেছে, ইরান ঐ হামলাকে সফল বলে অভিহিত করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরআবদুল্লাহিয়ান সোমবার বলেছেন, “জায়নিস্ট বা ইহুদিবাদী সরকারকে নিরস্ত করতে, শাস্তি দিতে ও হুঁশিয়ার করতেই” এ হামলা চালানো হয়েছে।
খামেনিও ইসরাইলকে “শাস্তি” দিতে ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ঐ হামলার পটভূমি ছিল ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসের কনস্যুলার অ্যানেক্স ভবনে সন্দেহজনক ইসরাইলি বিমান হামলা। আক্রমণে ইরানের আধা-সামরিক রেভলিউশনারি গার্ড বাহিনী কুদস ফোর্সের এক শীর্ষ কমান্ডারসহ অন্তত ১২ জন নিহত হন।
তবে বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান ও ইসরাইল একে অপরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুকে টার্গেট করে আসছে।
ইরান ও ইসরাইলের পালটা-পালটি
ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পরমাণু স্থাপনায় বিধ্বংসী হামলা চালানোর জন্য ইসরাইলকে সন্দেহ করা হয়। সিরিয়ায়, ইসরাইল বারবার ইরানি অস্ত্র চালানে বাধা দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরগুলিতে বোমা হামলা চালিয়েছে, একই সঙ্গে অন্যান্য রেভলিউশনারি গার্ড কর্মকর্তাদেরও হত্যা করেছে।
অন্য দিকে, ইরান কয়েক দশক ধরে ইহুদি ও ইসরাইলি স্বার্থসংশ্লিষ্ট লক্ষ্যবস্তুগুলো লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি বোমা হামলা ও বন্দুক হামলা চালিয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়।
কিন্তু দূতাবাসে হামলা ইরান সরকারের আঁতে আঘাত হানা।
“আমাদের কনস্যুলেটে হামলা করা মানে হচ্ছে আমাদের ভূমিতে হামলা করা,” খামেনি ১০ এপ্রিল বলেন।
ইরানে অনিশ্চয়তাপূর্ণ একটি মুহূর্তে এই হামলা হয়েছে। তবে খামেনির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
দেশটির কট্টরপন্থীরা নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থীদের কেউই নেই যারা একসময় বিশ্বশক্তির সাথে ইরানের পারমাণবিক চুক্তিটি চালু রেখেছিল।
হাসান রুহানি নিষিদ্ধ
এদের মধ্যে একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও রয়েছেন, যিনি ঐ প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ বছরের শুরুতে কর্তৃপক্ষ রুহানিকে অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টসে তার আসন ধরে রাখার জন্য নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করে।
অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টসের ৮৮জন সদস্য ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করবেন।
দেশের ক্ষমতার উপর কট্টরপন্থীদের দখল জোরদার হবার কারণে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর কোনও নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে, ইরানের অর্থনীতি ধ্বসে পড়ার জন্য ক্ষুব্ধ জনগণ একমাত্র তাদেরকেই দোষারোপ করছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর থেকে ইরানের মুদ্রা রিয়ালের দরপতন ঘটেছে। রিয়াল বর্তমানে সর্বনিম্নের রেকর্ড কাছাকাছি রয়েছে।
সোমবার ( ১৫ এপ্রিল) ডলারের বিপরীতে রিয়াল ৬৫৮,০০০ তে লেনদেন হয়েছে - প্রায় এক দশক আগে চুক্তিতে পৌঁছানোর সময় রিয়াল ছিল ৩২ হাজারের কম।
ইসরাইলের উপর ইরানের আক্রমণের ফলে দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন করার জন্য ইতিমধ্যেই তেহরানে সরকারি আইনজীবীরা জাহান-ই সানাত পত্রিকা এবং একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত শুরু করেছেন।
বিচার বিভাগের বার্তা সংস্থা মিজান প্রতিবেদনকে “সমাজের মনস্তাত্ত্ব সুরক্ষা বিঘ্নিত করে এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশকে অশান্ত করে তোলে” বলে বর্ণনা করে।
অন্যান্য সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট জানাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ সমন জারি করেছে বা মামলা করেছে। এর ফলে দেশটিতে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে নতুন করে দমনপীড়নের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি
দেশটিতে নারীদের জন্য মাথা ঢাকার ষ্কার্ফ বা হিজাব বাধ্যতামূলক করা আইন প্রয়োগ করার জন্য কর্তৃপক্ষ নতুন করে চাপ প্রয়োগের করার যা প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা আইএসএনএ’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তেহরানের পুলিশ প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্বাস আলী মোহাম্মদিয়ান বলেছেন, “অন্য সব প্রদেশের মতো তেহরানের পুলিশও হিজাব সংক্রান্ত যেকোন আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করবে।”
মাহসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে ২০২২ সালের দেশব্যাপী বিক্ষোভের পর থেকে অব্যাহত প্রতিবাদ হিসেবে, তেহরানের কিছু নারী এখনও তাদের চুল না ঢেকে রেখে রাস্তায় বেরুচ্ছেন। হিজাব না পরার জন্য পুলিশ অনেককে গ্রেপ্তার করেছিল।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলছেন, আমিনির মৃত্যুর জন্য ইরান দায়ী। মূলত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর কয়েক মাস ধরে চালানো নিরাপত্তা অভিযানে ৫০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয় এবং ২২ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করা হয়েছিল।
হিজাব পরা নিয়ে নতুন করে চাপ প্রয়োগের ফলে আবারও ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে তেহরানে।
ওদিকে, গুজব অব্যাহত রয়েছে যে সরকার শীঘ্রই দেশে পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধি করবে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভে শুরু হয়েছিল যাতে ৩০০ জনেরও বেশি লোক নিহত এবং হাজার হাজার গ্রেপ্তার হয়েছিল বলে জানা গেছে।
ঐসব উত্তেজনা, ক্ষমতার ওপর কট্টরপন্থীদের আধিপত্য এবং খামেনির বয়সের কারণে দেশে আরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে শনিবার ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছানোর আগেই হামলা সম্পর্কে ইরান বলেছিল যে এই “বিষয়টি এখানেই শেষ বলে মনে করা যেতে পারে ।”
তবে এর অর্থ এই নয় যে ইরান থেকে আর প্রতিশোধ মূলক অভিযোন চালানো হবে না।