অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বেনজীর আহমেদঃ সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সম্পদের অভিযোগ, দুদক নীরব


বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। ফাইল ছবি।
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। ফাইল ছবি।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণে অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকা।

এতে বলা হয়েছে, তার আয়ের সঙ্গে এসব সম্পদের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।

চাকরিতে থাকাকালে বেনজীর আহমেদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ অর্জন করেছেন বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তদন্ত করার দাবি জানিয়েছে বিশিষ্টজনরা।

দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি ও পুলিশের সাবেক শীর্ষকর্তারা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলছেন, অবিলম্বে বেনজীর আহমেদের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্যোগ নিতে হবে।

তারা বলছেন, সরকারির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা অসুন্ধান করা দুদকের এখতিয়ার।

কেউ অভিযোগ দেবে তার অপেক্ষা না করে দুদককে স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করা শুরু করা উচিত।

তদন্তে সত্যতা নিশ্চিত হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

কিন্তু বেনজীর আহমেদ ইস্যুতে এখন পর্যন্ত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে দুদক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকরি করে এতো বিপুল পরিমাণের সম্পদের মালিক হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

রিপোর্টে দেওয়া সম্পদের তথ্য সঠিক হলে, এখানে অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে।

তথ্য সঠিক হলে তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।

তা করতে না পারলে সমাজে বার্তা এ ধরণের যাবে, ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে দুর্নীতি করলেও কোনও শাস্তি হয় না।

এতে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে তার প্রমাণ বেনজীর আহমেদের সম্পদের ওপর করা এই রিপোর্ট ।

কিন্তু, দুর্নীতির আসল চিত্র যেন বেরিয়ে না আসে, তার জন্য সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণ জমা দেওয়ার (আচরণ) বিধিমালা সংশোধন করছে সরকার।

দুদকের ব্যবস্থা নেওয়া দরকারঃ টিআইবি

সংবাদপত্রে সাবেক আইজিপির বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের যে খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে, সেটা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে খুবই অস্বাভাবিক বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

ইফতেখারুজ্জামান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ আহরণ বাংলাদেশে এখন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে । এই যে সাবেক আইজিপির বিশাল সম্পদের খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে, তা হতবাক করার বিষয়।"

"রিপোর্টে সম্পদের যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেটিকে নির্ভরযোগ্য বলতে হবে।"

তাদের কাছে (পত্রিকার) লিখিত প্রমাণ আছে বলেও মনে করেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, "আমাদের জানামতে দুদক চাইলে স্বপ্রণোদিত হয়ে যেটুকু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে। অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু করতে পারে। এখন এটা কেন তারা করছে না, তা দুদকে (আপনারও) প্রশ্ন করা উচিত। তারা উত্তর দেবে, আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে করবো। কিন্তু কেউ অভিযোগ করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নাই।"

এই ধরণের পরিস্থিতিতে দুদক কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা কি ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের কারণে, নাকি অন্য কোনও কারণে, এটা তার ঠিক বোধগম্য নয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, "একজন সাবেক সরকারির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিশাল ধরণের অসামঞ্জস্য পূর্ণ সম্পদ আহরণের অভিযোগ উঠেছে । যা তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ার সম্ভবনা বেশ প্রকট। গণমাধ্যমে যেটুকু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে দুদক পদপেক্ষ গ্রহণ করবে। এটা যেহেতু তাদের এখতিয়ার। কাজেই এই ক্ষেত্রে দুদক যদি সক্রিয়তা না দেখায়, তাহলে প্রশ্ন তাকে তারা কি দায়িত্ব পালন করতে পারছে? এতে দুদককে নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণের চাইতে বরং দুদকের ওপর জনগণের আস্থার সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হবে।"

এখন রাষ্ট্রের করণীয় হলো কেউ যে বিচারের ঊর্ধ্বে নয় তা প্রমাণ করা’- বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, আইনগত প্রাতিষ্ঠানিক যে সক্ষমতা আছে তার যথাযথ প্রয়োগ করে দুর্নীতি দমন কমিশন অন্যান্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে জবাবহিদির জায়গায় নিয়ে আসা।

টিআইবির নির্বাহী প্রধান বলেন, "খুব সরল একটা বিষয় হচ্ছে, ব্যক্তি যেই হোক না কেন, তার একটা বৈধ আয় আছে। বেনজীর আহমেদ সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তার সম্ভাব্য যে বৈধ আয় হতে পারে, তার তুলনায় সম্পদের বিবরণী সম্পূর্ণভাবে অসামঞ্জস্য এটা খুবই পরিষ্কার। কাজেই এই অসামঞ্জস্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়, যে সম্পদের মালিকানা তিনি এবং তার পরিবারের নামে অর্জিত হয়েছে, সেটা যদি বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হয় তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।"

শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে সমাজে দুর্নীতি বাড়তে থাকবে উল্লেখ করে তিনি।

কোনও না কোনভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারলে বা ক্ষমতার সঙ্গে ছিলাম বলে আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে। মন যা চায় তা করতে পারবো, রাষ্ট্র আমাকে বাধা দেবে না বরং সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে এবং সুরক্ষা দেবে- এই রকম একটি বার্তা সমাজে ছড়িয়ে পরবে যাতে দুর্নীতি আরও বাড়বে

"কোনও না কোনভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারলে বা ক্ষমতার সঙ্গে ছিলাম বলে আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে। মন যা চায় তা করতে পারবো, রাষ্ট্র আমাকে বাধা দেবে না বরং সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে এবং সুরক্ষা দেবে- এই রকম একটি বার্তা সমাজে ছড়িয়ে পরবে যাতে দুর্নীতি আরও বাড়বে " বলে মত তার।

২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার অঙ্গীকারে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছিলো যে, কোনও ব্যক্তি যদি অবৈধ প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণ করে বা মালিক হন তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "আমাদের দেশের আইনের সঙ্গেও এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। আইনের শাসন ও তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারকে ফাঁকাবুলিতে রূপান্তরিত করার সুযোগ না দিয়ে সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে, ব্যক্তির পরিচয় বা অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা।"

চাকরির আয়ে এতো সম্পদ অর্জন একেবারে অসম্ভবঃ সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ

চাকরির আয় দিয়ে এতো সম্পদের মালিক হওয়া একেবারে অসম্ভব বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, "বেনজির আহমেদ অনেক বছর চাকরি করেছে। কিন্তু এখানে সম্পদের যে বিবরণ দেখেছি তাতে যে কোনও মানুষ দেখলেই মনে হবে- চাকরি করে একজন মানুষ কিভাবে এতো টাকার মালিক হয়? এখানে অন্য কিছু আছে।"

"দুর্নীতির বিষয়টি থাকতে পারে। তার যে বেতন সেটা দিয়ে এতো সম্পতি কিভাবে? এটা তো আপনার থাকা-খাওয়ায় চলে যায়। বেতন দিয়ে এই সম্পদ করা একেবারেই অসম্ভব। সেইক্ষেত্রে বাবা কিংবা শশুরের সম্পত্তি থাকা লাগবে"- উল্লেখ করেন সাবেক এই পুলিশ প্রধান।

১ লাখ টাকা বেতন পেলে ঢাকা শহরে চলতে-ফিরতে সমস্যা হয়ে যায় যদি আয়ের অন্য কোনও পন্থা না থাকে। এটা দিয়ে এতো কিছু করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, "১ লাখ টাকা বেতন পেলে ঢাকা শহরে চলতে-ফিরতে সমস্যা হয়ে যায় যদি আয়ের অন্য কোনও পন্থা না থাকে। আমি তো ৩০-৩২ বছর চাকরি করেছি। অবসরে যাওয়ার পর ১ থেকে দেড় কোটি টাকা পাওয়া যায়, সেটাও থাকে না। এটা দিয়ে এতো কিছু করা সম্ভব না।"

আইনের দৃষ্টিতে দুদক, তদন্তকারী সংস্থা যদি মনে করে বেনজির আহমদের সম্পদে নিয়ে বড় রকমের অসঙ্গিত আছে, তাদের উচিত তদন্ত করা। তাদের অবস্থান থেকে দুদক ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও উল্লেখ করেন সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ।

নূর মোহাম্মদ বলেন, "কয়েক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, বেনজির আহমেদ কিশোরগঞ্জের টেক্সটাইলের জন্য জেলার সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে তাকে দেখানো হয়েছে। এটা তাকে জিজ্ঞাসা করে রিপোর্টটি করলে আরও ভালো হতো যে, আপনার ট্যাক্স ফাইলে এইগুলো আছে কিনা। যে বাড়ি-ঘর, প্লট-ফ্ল্যাট, রিসোর্টের কথা বলা আছে, সেইগুলো ট্যাক্স ফাইলে আছে কিনা। যদি এখানে না থাকে, তাহলে এটাকে অসঙ্গতি ধরতে পারবেন।"

এখন আইনের দৃষ্টিতে দুদক, এনবিআর যদি মনে করে এখানে অনেক বড় আকারের অসঙ্গতি আছে, তাদের অবস্থান থেকে ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও উল্লেখ করেন নূর মোহাম্মদ।

বেনজীরের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান নেওয়া উচিতঃ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "কালের কন্ঠসহ যেসব পত্রিকায় রিপোর্ট করেছে, সেখানে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। এটা এক কথায় বলতে গেলে অচিন্তনীয়, মানুষের এতো সম্পদ হতে পারে চাকরিজীবনে!"

তিনি বলেন, "স্বাভাবিক নিয়মে যে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা তিনি পেয়েছেন, অবসরের পরে যা পেয়েছেন, সবকিছু মিলিয়ে ২ থেকে ৪ কোটি টাকার সম্পদ হলেও হতে পারে। কিন্তু আমরা অস্বাভাবিক একটা বৃদ্ধি দেখেছি। এখানে যা স্বাভাবিক তা থেকে শত হাজার গুণ বেশি সম্পদের বিবরণ আমরা দেখতে পেয়েছি।"

সাবেক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে দুর্নীতির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তারপরও দুদক কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও চিন্তা-ভাবনা করছে না, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।

তিনি বলেন, "এতে প্রমাণিত হবে দুদক ছোট-ছোট ব্যক্তিদের পেছনে লাগে, বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সুবিধা দিয়ে থাকে। এই রকম একটা ধারণা জণমনে আছে, সেটা আরও প্রাধান্য পাবে।"

কেউ মামলা করুক আর না করুক, দুদকের ক্ষমতা ও আইন আছে তারা নিজে করতে পারে বলে জানিয়ে ইশতিয়াক রেজা বলেন, "দুদকের উচিত তদন্ত করা। তার সম্পদের খোঁজ করা। তার নির্ধারিত গেটওয়ে বহির্ভূত হিসেবে কোনও আয় থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।"

ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে কতকিছু করা যায় বেনজির আহমেদের সম্পদের বিবরণ তার 'নিকৃষ্ট উদাহরণ' বলে দাবি করেন ইশতিয়াক রেজা।

১ লাখ টাকা বেতন পেলে ঢাকা শহরে চলতে-ফিরতে সমস্যা হয়ে যায় যদি আয়ের অন্য কোনও পন্থা না থাকে। আমি তো ৩০-৩২ বছর চাকরি করেছি। অবসরে যাওয়ার পর ১ থেকে দেড় কোটি টাকা পাওয়া যায়, সেটাও থাকে না। এটা দিয়ে এতো কিছু করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, "অনেকে এখন দুইভাবে চিন্তা করতে পারে, আমাকে যে করে হোক সরকারি চাকরি করতে হবে এবং পুলিশের চাকরি হলে তো আরও ভালো। মানুষের মধ্যে একটা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করছে বেনজির আহমেদের এই সম্পদের বিবরণ। আরেকটা হলো, কিছু হয় না। আমি যে এতো কিছু করলাম তার জন্য কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না।"

দেশে দুদকসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু 'দেখার কেউ নাই' বলে মনে করেন ইশতিয়াক রেজা।

তিনি বলেন, "বেনজির আহমেদ কি এতো সম্পদের কর দেন? যদি দেয় তখন কি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড জানতে চেয়েছে, এতো টাকা কোথায় পেলেন? কিভাবে উপার্জন করেছেন? পুরো বিষয়টিতে নৈতিকতার জায়গা থেকে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সরকারকে এই বিষয়ে একটা অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন, কারণ তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।"

ক্ষমতাধর ব্যক্তি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর কেন রিপোর্ট হয়, আগে কেন হয় না? এ প্রশ্ন করা হলে, এটা 'বাংলাদেশের বাস্তবতা' বলে উল্লেখ করেন সিনিয়র এই সাংবাদিক।

তিনি বলেন, দেশের আমলাতন্ত্র, পুলিশসহ বড় কর্মকর্তাদের বিষয়ে রিপোর্ট হয় না। কারণ তারা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। সাংবাদিক তথ্য পেলেও রিপোর্ট করে না। কারণ তখন ক্ষমতাধর মানুষগুলো পত্রিকার মালিককে নানা ধরণের হেনস্তা ও হয়রানি করে। রাজনৈতিকভাবে একটা সমস্যা হলো, সরকার সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ায় না। এই কারণে অনেক সময় করা সম্ভব হয় না।

দুদক এখন পরিপূর্ণভাবে সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে: মির্জা ফখরুল

দুদক এখন পরিপূর্ণভাবে সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল।

এখানে যে হারে দুর্নীতি চলছে, দুর্নীতির পাহাড় গড়ে উঠছে, সরকারী কর্মকর্তা, আমলা সবাই মিলে। এটাই প্রমাণিত হয়েছে এই নিউজটা থেকে। এটা নিঃসন্দেহে বেদনার বিষয়।

তিনি বলেন, "তারা যেভাবে চায় সেইভাবে দুদক চলে। আর বেনজীর আহমেদ একজন অত্যন্ত ক্ষমতাধর অফিসার ছিলেন,পরবর্তীতে তিনি বোধহয় আওয়ামী লীগের কোনও একটা দায়িত্বে আছেন। (ফ্যাক্ট চেক --এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি) ফলে, আওয়ামী লীগের উচ্চতর মহল থেকে দুদক যদি কোনও নির্দেশ না পায়, তাহলে তো তারা অনুসন্ধান করবে না। এখন পর্যন্ত তো সেটাই প্রমাণিত হয়ে আসছে।"

বেনজির আহমদের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারের আমলে 'স্বাভাবিক অবস্থা' বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "এখানে যে হারে দুর্নীতি চলছে, দুর্নীতির পাহাড় গড়ে উঠছে, সরকারী কর্মকর্তা, আমলা সবাই মিলে। এটাই প্রমাণিত হয়েছে এই নিউজটা থেকে। এটা নিঃসন্দেহে বেদনার বিষয়।"

পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্য সরকারির কর্মকর্তারা অনেকে এই রকম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন এবং দুর্বৃত্তায়ন করছে, এটাও প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব।

তিনি বলেন, "এই কথাগুলো আমরা বারবার করে বলছি যে, বাংলাদেশে অনত্যম প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। সেই দুর্নীতিতে সরকারের লোকেরা জড়িত, এটাই বড় সমস্যা।"

দুর্নীতি দমন কমিশনের ভবন (দুদক)
দুর্নীতি দমন কমিশনের ভবন (দুদক)

যথারীতি নীরব দর্শক দুদক!

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান করা উচিত।

তার সত্যতা নিশ্চিত হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান সমাজের বিশিষ্টজনরা।

কিন্তু এই নিয়ে এখন পর্যন্ত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে সংস্থাটি।

বেনজীর আহমেদের অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য সম্পর্কে দুদকের করণীয় প্রসঙ্গে জানতে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ ও সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন ফোন করে এবং মেসেজ পাঠালেও তারা সাড়া দেননি।

স্যার বলেছেন এই বিষয়ে কোনও আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে, এই নিয়ে তার কোনও বক্তব্য নেই।

পরে ১ এপ্রিল সংস্থাটির রাজধানীর সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ চাইলে পরের দিন (২ এপ্রিল) যেতে বলা হয়।

কিন্তু ওই দিন (২ এপ্রিল) দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ-এর একান্ত সচিব মো. আল মামুন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "স্যার বলেছেন এই বিষয়ে কোনও আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে, এই নিয়ে তার কোনও বক্তব্য নেই।"

আর দুদকের কমিশনার জহুরুল হক বলেন, বিষয়টি আমিও শুনেছি। এখন দেশের বাইরে আছি। দেশে গেলে কমিশনের সভায় এই ব্যাপারে কথা বলবো।

চাকরি জীবনে আয়ের হিসেব নিলে দুর্নীতি কমবে

চাকরিরত অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের নিয়মিত হিসাব চাওয়া হলেও দুর্নীতি কমবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কিন্তু এখন সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ সংশোধন করে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা সেটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয় না।

এখন উল্টো সরকার এই আইন সংশোধনে বাধ্যবাধকতা রহিত করার যে উদ্যোগ নিচ্ছে তাতে অসাধু সরকারি কর্মকর্তারা আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওই আইন সংশোধনের প্রস্তাবে বলেছে, ‘যদি প্রয়োজন হয়’, তাহলে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সরাসরি তার কাছ থেকে না নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে।

সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার বিধি বাতিল হলে অসাধু সরকারি কর্মকর্তারা আরও বেশি করে দুর্নীতি করবেন বলে মনে করেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, "সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার মতো কোনও বিধান না থাকলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নির্ভয়ে দুর্নীতি, তার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুযোগ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।"

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তারা যাতে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকতে পারে, তার জন্য সরকার অত্যন্ত সচেতন ভাবে এই সমস্ত আইনগুলো থেকে তাদেরকে বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে বলে দাবি করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, "যাতে দুর্নীতির আসল চিত্রটা না পাওয়া যায়।"

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, "এটা থাকলে ভালো যে, আমি যে অবস্থায় চাকরিতে যোগদান করেছি, তখন কি পরিমাণ সম্পদ ছিলো। আর কোথায় গিয়ে চাকরি শেষে করেছি, আয় কত হলো, এখন সম্পদ কত, তার পরিষ্কার বিবরণ থাকা দরকার। তাতে কোনও প্রশ্ন থাকবে না। আর দুর্নীতি রোধ করতে হলে মাথা থেকে শুরু করতে হবে। নিচে থেকে ২-৪ টা ধরলে হবে না। বড় জায়গা থেকে ২-৪ জনকে ধরলে দুর্নীতি কমবে।"

কুৎসার কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়ঃ বেনজীর

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যে অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে, এই নিয়ে তার বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করেও তিনি ধরেন নাই। কথা বলার বিষয়বস্তু উল্লেখ করে মোবাইলে মেসেজ পাঠালোও তার পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি।

তবে এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে একটি স্ট্যাট্যাস দিয়েছেন বেনজীর আহমেদ।

সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দু-একজন অনেক ক্ষিপ্ত, খুবই উত্তেজিত হয়ে এক্ষুনি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ লিখে ফেলছেন। দয়া করে সামান্য ধৈর্য্য ধরুন। ঘোষণাই তো আছে ‘‘কুৎসার কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়।”

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এর তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, হলি আর্টিসান বেকারির ভবনের সামনে তার শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। ২০১৮।
র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এর তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, হলি আর্টিসান বেকারির ভবনের সামনে তার শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। ২০১৮।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, র‌্যাব ও বেনজীর আহমদ

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‍্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত।

এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‍্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।

XS
SM
MD
LG