যুক্তরাষ্ট্রে ফেব্রুয়ারি মাসকে 'ব্ল্যাক হিস্টরি মান্থ' হিসাবে পালন করা হয়। এর মাধ্যমে এই দেশের ইতিহাসে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক বা ঘটনা বিশেষ অবদান রেখেছে , সেগুলো তুলে ধরা হয়। এর অংশ হিসাবে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা এই দেশের বিখ্যাত কিছু কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের অবদানের কথা তুলে ধরছে।
মোহাম্মদ আলী
মুষ্টিযুদ্ধ বা বক্সিং খেলার ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্যভাবে যে নামটি যুক্ত, তা হলো মোহাম্মদ আলী। কিন্তু তিনি শুধু মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন না, তার জীবনকালে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবং বিশ্ব মানবতার এক সাহসী কণ্ঠস্বর।
এই প্রতিভাবান মানুষটি ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লুইভিল, কেন্টাকিতে জন্মেছিলেন। জন্মের সময় তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র।
তার শৈশব এবং কৈশোরকালে আমেরিকান সমাজের সর্বস্তরে কৃষ্ণাঙ্গরা অপমানজনক বৈষম্যের শিকার হতেন। আলীকেও ছোটবেলা থেকে সেইসব বৈষম্য সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনই তা মন থেকে মেনে নেননি।
তিনি ১৯৬০ সালের অলিম্পিক্সে মুষ্টিযুদ্ধে মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বর্ণ পদক জেতেন ।
সনি লিস্টনকে হারিয়ে বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা জয়
জানা যায়, তার পরের বছর ১৯ বছর বয়সী এই কিশোর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে হন মোহাম্মদ আলী। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ক্যাসিয়াস ক্লে ছিল শ্বেতাঙ্গ মনিবদের দেয়া দাস নামের উত্তরাধিকার, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
ষাট-এর দশকের প্রথম দিকে নেশন অফ ইসলাম সংগঠন এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার নেতা ম্যালকম এক্সের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এই সম্পর্ক আলীর পরবর্তী জীবনে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কাজের ওপর গভীর ছায়া ফেলেছিল।
আলী ১৯৬৪ সালে ২২ বছরের এক ঐতিহাসিক ম্যাচে তৎকালীন বিশ্ব হেভিওয়েট চাম্পিয়ন সনি লিস্টনকে নক আউট করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
আলীকে ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক কনস্ক্রিপশন সার্ভিসের জন্য তলব করা হয়। সেসময় আমেরিকা সুদূর ভিয়েতনামে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে।
আলী ভিয়েতনামে আমেরিকার অভিযানের প্রতিবাদে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। সেনাবাহিনীতে যোগ না দেবার কারণে সরকারিভাবে তার ওপর নেমে আসে কঠিন শাস্তি। ছিনিয়ে নেয়া হয় তার বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা।
মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে আলী শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে জয়ী হন। তুলে নেয়া হয় তার ওপর থাকা আইনী নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু ইতোমধ্যে কেরিয়ারের মূল্যবান কয়েকটি বছর তিনি হারিয়েছেন ঐ নিষেধাজ্ঞার কারণে।
সময়ের কণ্ঠস্বর মোহাম্মদ আলী
আলীর সাহসিকতা এবং স্পষ্টবাদিতা ততদিনে আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে বীরের সমতুল্য করে তোলে।
সেসময় আলী আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য সফর করেন এবং বহু অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি তার যুক্তি তুলে ধরেন।
তার মতাদর্শ বৃহত্তর তরুণ সমাজ এবং কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করে।
আলী কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নিজে গর্বিত বোধ করতেন। তার সম্মানবোধ কৃষ্ণাঙ্গ এবং অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আবার শিরোপা জয়
আলী ১৯৭৪ সালে আরেক ঐতিহাসিক ম্যাচে শিরোপাধারী জর্জ ফোরম্যানকে নক আউট করে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন।
তার কয়েক বছর পর খেলা থেকে অবসর নিলেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলীর খ্যাতি আমৃত্যু অব্যাহত ছিল।
তিনি ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাক থেকে আমেরিকান জিম্মিদের সফলভাবে ছাড়িয়ে আনার কাজে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
বিবিসি-র এক জরীপে তিনি বিশ শতকের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন।
মোহাম্মদ আলী ২০১৬ সালের ৩ জুন তারিখে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান।