ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একসময় মধ্যপ্রাচ্যে এবং অন্যান্য জায়গায় ভীতি সৃষ্টি করেছিল, সম্ভবত সেটাই তারা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তারা একটি নতুন প্রচার অভিযানে বলছে, ইসলামিক স্টেটের এখন লক্ষ্য হচ্ছে শত্রুদের তারা যেখানেই পাবে সেখানেই হত্যা করবে।
জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে ইরানের কেরমান শহরে সন্ত্রাসী হামলায় প্রায় ৯০ জনকে হত্যা করার দাবী দিয়ে শুরু করে, ইসলামিক স্টেট (আইএস) তাদের সামাজিক মাধ্যমে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় আরও প্রায় ১০০টি হামলার দাবি করেছে।
‘’ইসলামিক স্টেট তাদের সৈন্য এবং আগ্রহী মুসলিমদের তাদের কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু করার আহবান জানাচ্ছে,’’ সংগঠনটির প্রকাশ করা একটি ভিডিওতে তাদের মুখপাত্রকে বলতে দেখা গেছে। সামাজিক মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান জিহাদওস্কোপের অনুবাদ অনুযায়ী, ভিডিওতে মুখপাত্র হামলার দায়িত্ব দাবী করেন।
ঐ মুখপাত্র আরও বলেন, “তাদের বাড়িঘরে হামলা করুন, তাদের হত্যা করুন এবং তাদের ক্ষতি করার সম্ভাব্য সব উপায় প্রয়োগ করুন।”
তাদের প্রচার অভিযানের নাম: “হত্যা করুন যেখানেই তাদের দেখবেন।”
তবে ঐ ঘোষণায় যে অভিযানের কথা বলা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক ষ্টেটের পুনরুত্থানের সূচনা কিনা, তা নির্ভর করে এই প্রশ্ন আপনি কাকে করছেন, তার উপর।
“এই ধরণের কাজ তারা যে আজ প্রথম করছে, তা কিন্তু নয়,” জিহাদওস্কোপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাফায়েল গ্লাক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন।
“তারা (আইএস) একটি ব্যানারের নীচে সবকিছু নিয়ে আসে। সাধারণত এই যুক্তিতে যে, তারা একই শিরোনাম ব্যবহার করে যত বেশী ঘোষণা দিবে, সেটা তত ভাল,’’ তিনি বলেন। “আমি মনে করি তারা একটু বাড়িয়ে বলছে।”
সিরিয়ায় আইএসের তৎপরতা বেড়েছে
তবে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরাও আশঙ্কা করছে যে আরও বেশী কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
“আইসিসের তৎপরতা বাড়ছে,” সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করে ভিওএ-কে বলেন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) রাজনৈতিক শাখার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি। আইসিস অন্য সংক্ষিপ্ত নাম ‘আইএস’ বা ‘দায়েশ’ নামেও পরিচিত।
“আইসিসের তৎপরতা বিশেষ করে আমাদের অঞ্চলে এবং সিরিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে,’’ সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক কাউন্সিলের প্রতিনিধি সিনাম মোহাম্মদ বলেন।
“আমাদের অঞ্চলে দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে গোষ্ঠীটি নানা ধরণের ১৬টি অভিযান এবং সিরিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে ৩০টিরও বেশি অভিযানের দায়িত্ব দাবী করেছে।’’
কিছু বিশেষজ্ঞ, যারা আইএসের দাবিগুলোর উপর নজর রাখছেন, তারা আরও লক্ষণীয় দিকগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
“আমরা যা দেখছি তা হল, মূলত এ বছরের শুরু থেকেই বড় দাগে আক্রমণ শুরু হয়েছে,’’ বলছেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, কাউন্টার এক্সট্রিমিজম প্রজেক্টেরের গবেষণা-বিশ্লেষক গ্রেগ ওয়াটার্স।
ওয়াটার্স ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, জানুয়ারি মাসে সিরিয়ায় আইএসের অন্তত ৬৫টি হামলার ঘটনা তিনি রেকর্ড করেছেন। এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা অঞ্চলগুলি, দুদিকেই ঐ হামলাগুলো হয়েছে।
এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানের সাথে, যখন সিরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশে ২১৫টি হামলা নথিভুক্ত করা হয়।
কুর্দিপন্থী গবেষক গোষ্ঠী রোজাভা ইনফরমেশন সেন্টার ঐ একই সময়ে এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আলাদাভাবে ১৯২টি আইএস আক্রমণ নথিভুক্ত করেছে।
“মনে হচ্ছে ২০২৩ সাল জুড়ে আইএস মাঠ-পর্যায়ে তাদের সংগঠন, তাদের সরঞ্জাম পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছে এবং যে কারণেই হোক না কেন, বিভিন্ন কারণে তারা হামলা চালাতে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে,’’ ওয়াটার্স বলেন।
আগে জঙ্গি গোষ্ঠীটির শক্ত ঘাঁটি ছিল রাক্কা ও দেইর ইজোরে, সেখানে এদের প্রভাব বাড়ছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
ওয়াটার্স বলেন, “আইএস মুহূর্তের মধ্যে যা তারা করতে চেয়েছে তা করেছে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এতগুলো হামলা চালাতে পেরেছে। আমি মনে করি এটি সত্যিকার অর্থেই প্রমাণ করে যে গোষ্ঠীটি সেখানে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বজায় রেখেছে এবং তাদের প্রচুর সংখ্যক ছোট ছোট দল আছে, যাদের প্রয়োজনে দ্রুত কাজে লাগাতে পারে।”
ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা যে মূল্যায়নের করছেন তা আইএসের তৎপরতা বৃদ্ধি ও এদের শক্তিশালী হওয়ার ধারণার বিপরীত। তারা বলছেন যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে “মূলত দমন করা হয়েছে।” সিরিয়া ও ইরাকে তাদের মোট এক হাজারের বেশি সদস্য নেই, যাদের মধ্যে রয়েছে বেসামরিক সদস্যও, যেমন যারা অর্থয়াণ এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সম্প্রতি (২৫ জানুয়ারি) পেন্টাগনের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, “ ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশের (আইএস) ছোটখাটো হামলা ছাড়া অন্যকিছু করার ক্ষমতা নেই।”
ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রশ্নের জবাবে ঐ কর্মকর্তা বলেন, “সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি এমন পর্যায়ে নেই যে তাদের অভিযান চালনোর মত সক্ষমতা আছে। তারা ভূখণ্ড দখল বা দখল করে ধরে রাখতে পারবে না।”
ঐ কর্মকর্তা আরও বলেন, আইএস প্রধানত শহরগুলো ছেড়ে চলে গিয়েছে। তারা সিরিয়ার মরুভূমির কিছু অংশে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করছে এবং একই ভাবে ইরাকের কিরকুক ও সালাহ আদ দিন প্রদেশের মতো দুর্গম এলাকা তারা বেছে নিয়েছে।
একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্র আইএস-এর তরফ থেকে হুমকির খুব কম সম্ভাবনাই দেখছে, অন্তত এখনকার মত।
“সন্ত্রাসবাদ বিরোধী চাপের কারণে ইরাক ও সিরিয়া থেকে সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ করার ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীর ক্ষমতা সম্ভবত হ্রাস পেয়েছে,’’ যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন। “বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা অভিজ্ঞ আইসিস নেতাদের কাজ যেভাবে ব্যহত করেছে, সে কারণে।”
ঐ কর্মকর্তা বিশেষত ইঙ্গিত করেন, ২০২৩ সালের শুরুর দিকের আমেরিকান অভিযানের দিকে, যাতে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে হামলার ষড়যন্ত্রকারী গুরুত্বপূর্ণ আইএস নেতাদের হত্যা করা হয়।
ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে কারা?
ইসলামিক স্টেটের মূল নেতৃত্বের অবস্থা এখন কেমন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত আগস্টে জঙ্গি দল আইএস-এর ভবিষ্যৎ খলিফা হিসাবে বর্তমান নেতা আবু হাফস আল-হাশেমি আল-কুরেইশির নাম ঘোষণা করার পর থেকে তার কাছ থেকে প্রায় কিছুই শোনা যায়নি।
পশ্চিমা সন্ত্রাসবিরোধী এক সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, “আমি মনে করি তারা নিজেরাই পর্যুদস্ত।”
জাতিসংঘকে দেয়া সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্যে এমন আভাসও পাওয়া যায় যে, আইএসের বৈশ্বিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের পরিচালনা ও তার নিয়ন্ত্রণ হয়তো সিরিয়া এবং ইরাক থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
“মনে হচ্ছে, তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শাখাগুলো এখন আর প্রধান এলাকাগুলোতে নেই,’’ সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন। তিনি তাদের আফগান শাখা আইসিস-কে’র কথা উল্লেখ করে বলেন, “যেসব ষড়যন্ত্রের কথা আমরা জানি, তার বেশিরভাগই আইসিস-কে’র কাছে চলে গেছে।”
ইসলামিক স্টেটের কিছু আফ্রিকান শাখার ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধরণা করা হচ্ছে। যার ফলে, জাতিসংঘের কিছু সদস্য দেশ বলছে, আফ্রিকায় এদের স্থানান্তরিত হওয়ার “সম্ভাবনা বেশি।”
সিরিয়া ও ইরাকে গোষ্ঠীটি চাপের মুখে থাকা সত্ত্বেও বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা এদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে নারাজ, বিশেষ করে সিরিয়ায়।
‘’সিরিয়া হচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ডের এমন একটা এলাকা যা সহসা হাড়িয়ে যাবে না,’’ পশ্চিমা সন্ত্রাসবিরোধী সাবেক কর্মকর্তা বলেন। সিরিয়ার পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘’এহচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীল এবং দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতায় অভ্যস্ত” একটি দেশ।
'সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের আবাস'
সিরিয়ায় হাজার হাজার আইএস সমর্থক পুনরায় লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে এবং এসডিএফ পরিচালিত কারাগারগুলোতে প্রায় ৯ হাজার বন্দী আইএস যোদ্ধা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কারাগার নেটওয়ার্ককে “বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক সংখ্যক সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের আবাস” বলে অভিহিত করেছেন।
আইএস একাধিকবার কারাগার থেকে গণপলায়নের চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে খুব কমই সফল হয়েছে।
তবে জাতিসংঘকে দেয়া গোয়েন্দা তথ্য, এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, গত আগস্টে আইএস সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এসডিএফ পরিচালিত কারাগার থেকে কিছু নেতা ও কর্মীদেরকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
কারাবন্দি যোদ্ধাদের মাঝে অনেকেই অপুষ্টি বা রোগে ভুগলেও, আইএস যদি বৃহত্তর কোন ষড়যন্ত্র করে সফল হয়, তবে এতে যে উদ্বেগের কারণ থাকবে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও একমত।
ঐ উর্দ্ধতন আমেরিকান কর্মকর্তা বলেছেন, “অবশ্যই এদের কয়েক শতাংশ হুমকি হতে পারে। এরা তো লড়াইয়ে অভ্যস্ত আইএস যোদ্ধা।”